ঈশ্বরদী সরকারী কলেজে চাঁদাবাজী ও দূর্ণীতি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ায় অধ্যক্ষসহ পাঁচজন শিক্ষকের জীবণনাশের হুমকি

পাবনা প্রতিনিধি : ঈশ্বরদী সরকারী কলেজে গত সোমবার কলেজ চত্বরে অনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক চরম এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, কলেজে একদল দূবৃত্ত মিথ্যা-বানোয়াট-প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজ স্বার্থ চরিতার্থের জন্য অধ্যক্ষসহ কলেজ শিক্ষকদের কলেজ ছাড়া করার জন্য বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহণ করে। শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, কলেজে ক্লাস শেষে বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে মাদক কেনাবেচা ও সেবনকারীদের আড্ডা। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে মোটর সাইকেল নিয়ে অনৈতিক মহোৎসবে মেতে উঠে তারা। দীর্ঘদিনের নানা পরিক্রমায় কলেজের সামনের জমি নিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতি হয়ে আছে। তারই প্রেক্ষিত বিবেচনায় হাইকোর্টের রায়ে কলেজের সামনের জমি কলেজ কর্তৃপক্ষের না থাকায় দুপুরের পর থেকে রাত পর্যন্ত কলেজের প্রধান গেট বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দেন কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুর রহিম। কলেজের প্রধান গেট কয়েকঘন্টা বন্ধ থাকায় এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ায় তাৎক্ষণিক প্রধান গেট খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ মহোদয়। দীর্ঘদিন কলেজ থেকে চাঁদাবাজী ও দূর্ণীতি করে আসা এলাকার প্রভাবশালী দূস্কৃতিকারী মহল রাত্রে কলেজের সকল কলাপসিবল গেটের তালা সুপার গ্লু দিয়ে বন্ধ করে দেয় এবং পরের দিন পেশি শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচী প্রদর্শন করে ওই মহলটি। সকালে সকল শিক্ষক ও কর্মচারীরা কলেজে এসে তালার মধ্যে সুপার গ্লু লাগানো দেখে হতভম্ব ও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে যায়। তারপর থেকে কলেজে মধ্যে চলছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অকথ্য গালিগালাজ, স্বশস্ত্র মোটর সাইকেল মহড়া, কুরুচিপূর্ণ শ্লোগান দিয়ে ব্যানার পোষ্টারের মাধ্যমে শিক্ষকদের বিব্রত করা হয় এবং অনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শিক্ষকদেরকে ভূমিদস্যু, দূর্নীতিবাজ, শিবির, রাজাকার, জামাত ক্যাডার খেতাব দিয়ে ও জীবণনাশের হুমকি প্রদানের মাধ্যমে কলেজ থেকে বিতাড়িত করার অপপ্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তারা।


ঘটনার বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায় কলেজের মধ্যে এলাকার প্রভাবশালী দুই-একজন মাষ্টার রোল কর্মচারী এবং বিভিন্ন সরকারের সময় বা সব দলের নেতা হিসাবে পরিচিত একজন শিক্ষক এসব ঘটনার ইন্ধনদাতা হিসাবে কাজ করছে। বছর দুই আগে প্রফেসর সবুর খান অধ্যক্ষ হিসাবে কলেজে যোগদানের পর আদালতে বিচারাধীন কলেজের সামনে ১.৩৩ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য জমির মালিকানা দাবীদারের পক্ষে জমি অধিগ্রহণের বিনিময়ে ৫ কোটি টাকা ঘুষ প্রদানের প্রস্তাব দেন। কিন্তু অধ্যক্ষ প্রফেসর সবুর খান ওই প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় এলাকার কিছু মাস্তান ও দুস্কৃতিকারীদের দিয়ে অবৈধ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যাক্ষ মহোদয়কে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করেন, যা বিভিন্ন গণ মাধ্যমে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।

এ কারণে তৎকালীন অধ্যক্ষ মহোদয় মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করে উক্ত শিক্ষককে ভোলার হাতিয়া দ্বীপ সরকারী কলেজে বদলী করে দেন। উল্লেখ্য যে, উক্ত শিক্ষককে ইতিপূর্বে নারী কেলেংকারীর কারণে সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ থেকে শাস্তিস্বরূপ ভোলার সরকারী দ্বীপ কলেজে বদলী করা হয়েছিল। উক্ত ঘটনায় তৎকালীন কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর সবুর খান উক্ত দূস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। যা কিছুদিন পূর্বে সেই মামলার চার্জশীট দাখিল হয়েছে। উল্লেখ্য যে, কলেজের সকল শিক্ষক স্বাক্ষর দিয়ে উক্ত দূস্কৃতিকারী শিক্ষককে পূনরায় ঈশ্বরদী সরকারী কলেজে বদলী না করার জন্য মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ স্বরূপ দরখাস্ত প্রেরণ করে ব্যার্থ হন। কলেজের সকল শিক্ষককে হতভম্ব করে উক্ত শিক্ষক তদবিরের মাধ্যমে পুনরায় ঈশ্বরদী সরকারী কলেজে বদলী হয়ে আসেন। বদলী হয়ে আসার পরেই পূর্ববর্তী অধ্যক্ষকে সাহায্যকারী সকল শিক্ষকদের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার উন্মাদনায় মেতে উঠেন। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে আরও জানা যায় যে, প্রতিবছর ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সময় প্রসপেক্টাস বিক্রির নামে লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধ আয় করতো আশেপাশের কিছু ছাত্র নামধারী মাস্তান ও দুস্কৃতিকারী। বর্তমান অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুর রহিম কলেজে যোগদান করার পর থেকে প্রসপেক্টাস বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়াও উক্ত দূস্কৃতিকারী মহল পূর্ববর্তী বিভিন্ন অধ্যক্ষের সময় হুমকি-ধামকি দিয়ে বিভিন্ন ফান্ড থেকে ভূয়া ভাউচারের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজীর প্রক্রিয়া চালু রেখেছিল। কলেজের দু’একজন মাষ্টার রোল কর্মচারী এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় কোটি টাকা দূর্নীতির মাধ্যমে আয় করে অর্থ-সম্পদের মালিন হন। কিন্তু বর্তমান অধ্যক্ষ সমস্ত দূর্ণীতি ও অনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ায় অধ্যক্ষসহ তাকে সাহায্যকারী শিক্ষকদের উপর ভীষনভাবে ক্ষুদ্ধ হয় এবং তাদেরকে বিতাড়ন করার জন্য জীবননাশের হুমকী প্রদানসহ নানা পন্থা অবলম্বন করেই চলেছে। মাস দুয়েক আগে কলেজে এক প্র্রভাবশালী মাস্টাররোল কর্মচারী দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তি কমিটির আহবায়ক জনাব মোঃ নজরুল ইসলামের কাছে অবৈধ ছাত্র ভর্তির প্রস্তাব দিলে তিনি নাকচ করে দেন। এতে উক্ত কর্মচারী জনসম্মুখে জনাব নজরুল ইসলামকে অকথ্য ভাষায় গালী-গালাজ করেন। কলেজের শিক্ষকরা প্রতিবাদ করে তাকে চাকরীচ্যুত করার দাবী করলে উক্ত কর্মচারী ক্ষমা চান এবং ঘটনার পূনরাবৃত্তি করবে না মর্মে লিখিত অঙ্গীকারনামা দেওয়ার প্র্রেক্ষিতে অধ্যক্ষ মহোদয় উক্ত কর্মচারীকে শেষবারের মতো সুযোগ প্রদান করেন। কিন্তু সুযোগবুুঝে প্রতিবাদকারী শিক্ষকদের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কলেজ থেকে তাড়ানোর নানা অপকৌশল গ্রহন করে।

এছাড়াও আরও জানা যায় কলেজ মসজিদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষকরা ব্যক্তিগতভাবে চাঁদা তুুলে, মসজিদ তহবিল থেকে অর্র্থ উত্তোলন ও এলাকার ধর্র্র্মপ্রাণ মুসল্লিদের সহযোগিতা নিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করা হয়। মসজিদ উন্নয়ন কাজ করার সময় ছাত্রনেতা নামধারী কিছু মাদকসেবী মসজিদ কমিটির আহবায়কের কাছে চাঁদা দাবী করে। সেই সময় চাঁদা না দিয়ে এলাকাবাসীর কাছে চাঁদাবাজীর খবর প্রকাশ করে দেওয়ায় উক্ত মহল ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয়। এছাড়াও কলেজের সামনের জমি অধিগ্রহণের জন্য এলাকার প্রভাবশালী একটি মহলকে দিয়ে বিভিন্ন সময় একাধিক কলেজ অধ্যক্ষকে দিয়ে কোটি টাকার গোপনভাবে অনৈতিক প্রলোভন দেখায়। জনশ্রুতি আছে যে, কাজটি অধ্যক্ষকে দিয়ে করাতে পারলে উক্ত প্রভাবশালী মহলকে কয়েক কোটি টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উক্ত জমির দাবীদার পক্ষ। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় দাবীদার পক্ষ হাইকোর্টের স্মরণাপন্ন হন। এমতাবস্থায় হাইকোর্ট কলেজ অধ্যক্ষ, জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ভূমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রায় প্রদান করেন। হাইকোর্টের রায়ে অধ্যক্ষ মহোদয় জেলা প্রশাসক, পাবনাকে ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব প্রেরণ করেন। এতে পূর্ববর্তী অনৈতিক সুবিধাভোগী প্রভাবশালী মহল ভাগ-বাটোয়ারার টাকা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকায় তারা প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠেছে। উল্লেখিত ঘটনার প্রেক্ষাপটে এলাকার প্রভাবশালী মহল অধ্যক্ষসহ তাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্যকারী শিক্ষকদের প্রতি চরমভাবে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে।


তথ্যসূত্রে আরও জানা যায় ঈশ্বরদী সরকারী কলেজে ২০০৬ সালের দিকে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল মোট ৪৩৬ জন। কলেজে পাঠদানের কোন পরিবেশ না থাকায় এ অঞ্চলের অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের উক্ত কলেজে ভর্তি করাতেন না নিরাপত্তাহীনতার কারণে। কিন্তু কিছু নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও অধ্যক্ষ এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী জনাব আলহাজ্ব শামসুর রহমান শরীফ ডিলু মহোদয়ের অক্লান্ত চেষ্টা, পরিকল্পনা ও যথাযথ বাস্তবায়নের কারণে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটে। বর্তমানে কলেজের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। ছয় তলা একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণে টেন্ডার সম্মন্ন হয়েছে। ১২টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আইডিজি প্রকল্পের মাধ্যমে নিজস্ব প্রকল্প তৈরি করে শিক্ষার মান উন্নয়নে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ও দু’চারজন শিক্ষককে সাথে নিয়ে পরিবেশের উন্নয়নে নৈতিকতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ণ কর্মকান্ডের মূলমন্ত্র বিকাশে বিভিন্ন বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে কলেজের মধ্যে দূর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে শুণ্য টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দূর্ণীতি ও নীতিবাচক মানসিকতার মূলোৎপাটন করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে পূর্বের অনৈতিক সুবিধাভোগী দূর্নীতি পরায়ণ ও চাঁদাবাজদের মাঝে ভিন্ন রকমের তৎপরতা শুরু হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, বর্তমানে কলেজে এইসব বিভিন্ন নারকীয় কার্যক্রম এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। ফলে ঘটনার সাথে অভিযুক্ত শিক্ষকমহল সুষ্ঠ্যু তদন্ত দাবী করছে। তারা বলছেন, যে কোন তদন্তে তারা যদি দোষী সাবস্ত্য হন তাহলে সর্বোচ্চ শাস্তি গ্রহণ করতে তারা প্রস্তুত। নতুবা তাদের সম্মানহানীকর যেসব কর্মকান্ড পরিচালিত হয়ে চলেছে তার যথাযথ ও সুষ্ঠ্যু প্রতিকার অতি জরুরীভাবে দাবী করছেন।
জীবননাশের ভয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষকবৃন্দ তাদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে উক্ত সংবাদটির বিস্তারিত বিবরণ বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ নানা সরকারী প্রশাসনমহলে প্রতিকারের জন্য অবহিত করছে।