কিয়ামত ও পরকালে বিশ্বাস ঈমানের অংশ। পরকাল অস্বীকার করলে মানুষ ঈমানহারা হয়ে যায়। সাধারণত পরকাল বলতে বিচার দিবস ও তার পরবর্তী সময়কে বোঝানো হয়। তবে মৃত্যুর পর থেকেই যেহেতু পরকালীন সুখ ও শাস্তি, জান্নাত ও জাহান্নামের ছোঁয়া মানুষ পেতে শুরু করে, তাই গবেষক আলেমরা মৃত্যু-পরবর্তী সময় থেকেই পরকালের সূচনা বলে মত দিয়েছেন। সুতরাং মৃত্যুর পর ফেরেশতাদের সমাদার ও অনাদর, কবরের প্রশ্ন-উত্তর, সুখ ও শাস্তি, পুনরুত্থান, হিসাব, মিজান, পুলসিরাত, জান্নাত ও জাহান্নাম সব কিছু পরকালের অন্তর্ভুক্ত।
কিয়ামত বেশি দূরে নয়
কিয়ামতের সঠিক সময় আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী কিয়ামত খুব বেশি দূরে নয়। কেননা কোরআনে কিয়ামতের সময়কাল বোঝাতে ‘নৈকট্যবাচক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কিয়ামত সম্পর্কে জানতে চাইলে আল্লাহ ওহি নাজিল করেন। ইরশাদ হয়, ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে আছে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১)
আল্লাহ আরো বলেন, ‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা কামার, আয়াত : ১)
অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আপনার কাছে কিয়ামত কখন হবে জিজ্ঞাসা করছে? তার আলোচনার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক! তার পরম জ্ঞান আছে তোমার প্রতিপালকের কাছে।’ (সুরা নাজিয়াত, আয়াত : ৪২-৪৪)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আপনার কাছে তার কোনো জ্ঞান নেই এবং নেই কোনো সৃষ্টির কাছেও। বরং এর উদ্দেশ্য ও প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকে। তিনিই তা সংঘটিত হওয়ার নির্ধারিত সময় জানেন।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৮/৩১৮)
কিয়ামতের নিদর্শন
কোরআন-হাদিসে কিয়ামতের সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বর্ণনা করা না হলেও কিয়ামতের কিছু নিদর্শন বর্ণনা করা হয়েছে। যার মধ্যে কিছু নিদর্শন রয়েছে ‘আলামতে কুবরা’ বা বড় নিদর্শন এবং কিছু নিদর্শনকে ‘আলামতে সুগরা’ বা ছোট নিদর্শন বলা হয়েছে। বড় নিদর্শনগুলো কিয়ামতের অতি নিকটবর্তী সময়ে সংঘটিত হবে। আর রাসুল (সা.)-এর পর মানুষ যত বেশি সময় পার করবে তত বেশি ছোট নিদর্শন প্রকাশ পাবে। ছোট আলামতের মধ্যে রয়েছে, সম্পদের প্রাচুর্য বাড়া, সততা না থাকা, আসমানি জ্ঞানের চর্চা কমে যাওয়া, ব্যভিচার, সুদ, বাদ্য ও অশ্লীল গান, মদ ও মাদকদ্রব্য বৃদ্ধি পাওয়া, মানুষ হত্যা, উলঙ্গপনা, মিথ্যা সাক্ষ্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বৃদ্ধি পাওয়া। বড় নিদর্শনগুলোর মধ্যে আছে, দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ, ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ.)-এর অবতরণ, ইয়াজুজ ও মাজুজের আগমন, পূর্ব, পশ্চিম ও আরব উপদ্বীপে তিনটি ভূমিধস হওয়া, ধোঁয়া ও পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় হওয়া ইত্যাদি। (শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রা.), মাজমাউল ফাতাওয়া : ২/১৩৭)
কিয়ামতের আগের সমাজ যেমন হবে
যখন চরিত্র দুর্বল হবে, মা-বাবার প্রতি সন্তানের অবাধ্যতা বৃদ্ধি পাবে। সন্তানরা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে। তারা তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করবে যেমন মুনিব তার গোলামের সঙ্গে করে। সামাজিক রীতি ও মূল্যবোধ পাল্টে যাবে। তাতে ভালো-মন্দের মিশ্রণ ঘটবে। নিচু শ্রেণির মানুষ জাতির শাসক ও নেতা হবে। অযোগ্য ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে। মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ-সম্পদ থাকবে। বিলাসিতা ও অপচয় বেড়ে যাবে। মানুষ গর্ব করবে অট্টালিকার উচ্চতা আর ভোগের সামগ্রী ও আসবাবপত্র নিয়ে। যদিও তারা ফকির ছিল ও দুঃখ-কষ্টে জীবন কাটাত এবং তারা অন্যের দয়ায় জীবন যাপন করত। যেমনটি রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দাসি তার মনিবকে প্রসব করবে, তুমি দেখতে পাবে যাদের পায়ে জুতা এবং পরনে কাপড় নেই, নিঃস্ব ও বকরির রাখাল তারা উঁচু উঁচু প্রাসাদ তৈরিতে পরস্পর প্রতিযোগিতা করছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১)
ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘এর উদ্দেশ্য হলো যুগের পরিবর্তন সম্পর্কে অবহিত করা, বেদুঈনরা শাসকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, অত্যাচারীরা রাষ্ট্রের মালিক হবে। অতঃপর তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাবে, তারা অট্টালিকা নির্মাণে মনোযোগী হবে এবং তা নিয়ে অহংকার করবে। আর আমরা যেন এ যুগেই তা স্বচক্ষে দেখছি।’ (জাওয়াহিরুল হারিরিহ : ২/৩৫)
যেভাবে সংঘটিত হবে কিয়ামত
ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে। সেদিন প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ভেঙে যাবে। আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত, গ্রহ-নক্ষত্র কোনো কিছুই আপন অবস্থায় অবশিষ্ট থাকবে না। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে কিয়ামত কখন ঘটবে? আপনি বলুন! প্রকৃতপক্ষে তার জ্ঞান শুধু আমার প্রতিপালকের কাছেই আছে। শুধু তিনিই যথাসময়ে তা প্রকাশ করবেন; তা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে একটি ভয়ংকর ঘটনা হবে। আকস্মিকভাবেই তা তোমাদের ওপর আপতিত হবে। …’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৮৭)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবী যখন আপন কম্পনে প্রচণ্ড রকম প্রকম্পিত হবে এবং পৃথিবী তার ভার বের করে দেবে, মানুষ বলবে -এর কী হলো? সেদিন পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। কেননা তোমার প্রতিপালক তাকে আদেশ করবেন।’ (সুরা জিলজাল, আয়াত : ১-৫)