জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্র যেন এক আলোর বাতিঘর

নির্মলেন্দু সরকার বাবুল,দুর্গাপুর,নেত্রকোনা।
লেখক, কবি, সহিত্যিক, ছড়াকার আর ঔপন্যাসিকদের পদচারণায় মুখরিত বিরিশিরি’র ছোট্ট জনপদ গাভিনা গ্রাম

সৈয়দ আরিফুজ্জামান : মাঘ মাসের কনকনে শীতের পড়ন্ত বিকেল। গতকাল ২৩ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার গাভিনা গ্রামে জড়ো হয়েছিলেন প্রতিথযশা জ্ঞাণ পিপাসু শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের অনেক গুণীজন। দিনটি ছিল জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্রের কবি-সাহিত্যকদের নিয়ে সত্যানুবর্তিতা ও আত্মজাগরণের গল্প করার বাৎসরিক নিয়মিত আসর। এবারের আয়োজন বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে সম্মাননা প্রাপ্ত প্রিয়জন কথাশিল্পী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদার, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক বিধান মিত্র, লেখক ও সাংবাদিক ইশরাত জাহান ঊর্মি ও গল্পকার দীলতাজ রহমান এর উপস্থিতি।

গারো পাহাড়ের পাদদেশে সাদা মাটির পাহাড়, হাওড়, নদী, খাল-বিল আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা নিজস্ব কৃষ্টি, ভাষা ও আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে সমৃদ্ধ জেলা নেত্রকোনা। জেলার একটি অন্যতম জনপদ দূর্গাপুর উপজেলা। বাঙালী-আদিবাসী মিলে এখানে গড়ে তুলেছে সাংস্কৃতিক পরিম-লে এক ইর্ষনীয় ঐতিহ্য।

পাহাড়ের কূল ঘেষে বয়ে চলা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যরে অনন্য প্রতীক সুমেশ্বরী নদী। পাহাড়, নদী আর আবহমান বাংলার শান্ত-সৌম্য, সবুজ-শ্যামল রূপ নিয়ে একটি আদর্শ গ্রাম গাভিনা। নগর জীবনের কোলাহল থেকে ভিন্ন অন্য এক জগৎ। এমন একটি জনপদে আলো ছড়াতে দীপক সরকার ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্র।

সকাল থেকেই গ্রামের শিশু, কিশোর-কিশোরী, বৃদ্ধাসহ সকলের মাঝেই উৎকন্ঠা আর অপেক্ষা। বছরের এই দিনটিতে সবাই প্রতিক্ষায় থাকেন প্রাণের এই মিলন মেলায় নিজেদের স্মৃতিঋদ্ধ করে নিতে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ভাব-গম্ভীর পরিবেশ, পিনপতন নীরবতা। একের পর এক ছড়া ও আবৃত্তির সূরে আপ্লুত গোটা উপস্থিতি। মঞ্চে এসে উপস্থিত হলেন আমন্ত্রিত অতিথি। মোমবাতি প্রজ্জলনের সাথে সাথে সমবেত কন্ঠে শিল্পিরা গেয়ে উঠলেন-

মঙ্গল দ্বীপ জ্বেলে
অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু
তবু যারা বিশ্বাস করে না তুমি আছ
তাদের মার্জনা করো তুমি।

সাত বছরের দীর্ঘ পথচলার ধারাবাহিক এই আয়োজনে অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে ও সম্মাননা স্মারক প্রদানের মাধ্যমে বরণ করে নেন জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্রের সদস্যরা। দীপক সরকারের প্রাঞ্জল উপস্থাপনায় শুরু হয় সাহিত্য অঙ্গনের প-িত ও গুণী মানুষদের স্মৃতিচারণ, ভাবনা ও সাহিত্য দর্শন নিয়ে আলাপচারিতা।

জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্রের সভাপতি এডভোকেট মানেশ সাহা’র সভাপতিত্বে দিবসের সার্বিক আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ড. অর্ধেন্দু শেখর রায়।

এবারের আয়োজনে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলেন কথাশিল্পী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদার। যিনি দীর্ঘসময় জেলা প্রশাসক হিসেবে নেত্রকোনায় দায়িত্ব পালনকালীন এ অঞ্চলের শিল্প সাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করতে উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দেওয়ান মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম তার বক্তব্যে জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্রের সাফল্য কামনা করেন। তিনি প্রযুক্তির সহায়তায় এই পাঠকেন্দ্রের বিকাশ ঘটানোর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এর সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

‘ই-পুস্তক বনাম মুদ্রিত পুস্তকের ভবিষ্যৎ’ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করতে গিয়ে লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্রকে ই-পাঠাগারে রূপান্তরের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।

লেখক ও গবেষক আলী আহমদ খান আইয়োব ‘ গ্রাম পর্যায়ে পাঠাগার ভাবনা’ বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি তার বক্তব্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে পাঠাগার স্থাপন ও শিক্ষার্থীদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রতি জোর দেন।

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা খানম।

অন্যান্যের মধ্যে আরোও উপস্থিত ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ হক, এডভোকেট প্রবীর মজুমদার চন্দন, সুসং সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান, জেলা পরিষদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শফিক, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পারভীন আক্তার, সংস্কৃতি কর্মী জেসমিন আক্তার, উপজেলা প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুবল রঞ্জন কর, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীরেশ্বর চক্রবর্তী প্রমুখ।

পরিশেষে এবারের আয়োজনের সমাপ্তির পালা। জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্রের সাফল্য গাঁথার পথ ধরে পরবর্তী প্রজন্মের উপযুক্ত হয়ে আলোর বাতিঘর হয়ে থাকবে এই পাঠকেন্দ্র এমন প্রতিশ্রুতি আর প্রত্যাশা উপস্থিত সকলের কন্ঠেই।