সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা

জন্মিলে মৃত্যু হবে এটা সতঃসিদ্ধ কথা। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু কোনমতেই মেনে নেওয়া যায়না। যেমন সড়ক দৃর্ঘটনায় মৃত্যু। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কেউ মৃত্যু বরণ করলে তা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। এর ফলে হঠাৎ করে বিপর্যয় নেমে আসে একটি পরিবারে। সেই শোক গোটা পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের বুকে শেলের মত বিঁধে থাকে সারা জীবন। অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় সমাজ ও দেশ হারায় তার কৃতি সন্তানদের। এ দুর্ঘটনা অনেককে চিরজীবনের মত পঙ্গু করে দেয়।
জীবনে চলার পথে রুজি রোজগার কিংবা যে কোন প্রয়োজনে আমাদেরকে ঘরের বাইরে বেরুতে হয়। কিন্তু রাস্তাপথে চলতে গিয়ে যদি কেউ লাশ হয়ে নিজ আঙিনায় ফেরে এর চেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা আর কি হতে পারে?
আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। বলতে গেলে বছর গড়ানোর সাথে সাথে তুলনামুলকভাবে সড়ক দুর্ঘটনার হার ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭ শ ২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মোট ৫ হাজার ২শ ২৭জন। ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১ শ ৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহত হওয়ার সংখ্যা ছিলো ৪ হাজার ৪ শ ৩৯ জন। ফলে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার সংখ্যা ৭শ ৮৮ জন বেশি। আর এই পরিসংখ্যান বিষয়ে জানিয়েছেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
গত ৪ জানুয়ারি নিসচা’র মহাসচিব এহসানুল হকরে উপস্থিতিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ মিলনায়তনে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে ইলিয়াস কাঞ্চন আরো বলেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বিগত ২ বছরের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, ত্রæটিপুর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনগণের অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ত্রæটি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া ইত্যাদি মুল কারণ বলে চিহ্নিত করা যায়। তিনি উল্লেখ করেন যে, গত বছর রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১শ৬২টি। এতে নিহত হয়েছেন ১শ ৯৮জন ও আহত ৩শ ৪৭ জন। নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩০টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন ও আহত হয়েছেন ১শ ৫৭ জন। এ দুর্ঘটনাগুলোতে নিখোজ রয়েছেন ১শ ১০ জন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনগুলো হলো –বাস ৯শ ৯২ টি, ট্রাক ১হাজার ৩৩টি, মোটর সাইকেল ১হাজার ৯৮ টি, কাভার্ড ভ্যান ১শ ৬০টি, মাইক্রোবাসে ১শ ৫৮টি, নছিমন ৮৩টি, কার ৭৯ টি ও অন্যান্য (সিএনজি/ভ্যান/পিক আপ) ২ হাজার ১শ ৭৮ টি। এসকল যানবাহনের মোট নিহত চালক হলো ১হাজার ১শ ৯০জন।
নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন আরো উল্লেখ করেন যে, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পুরোপুরি কর্যকরী না হওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ভুমিকা রাখা যাচ্ছেনা। এ বিষয়ে আরো সোচ্চার হওয়া ও আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
বর্তমান সমাজে ঘর হতে বের হলেই প্রত্যেক মানুষকেই সড়ক দুর্ঘটনা নামক আতংক তাড়া করে বেড়ায়। প্রতিদিন দেশের কোন না কোন অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে। যার ক্ষয়-ক্ষতি পরিবারগুলোকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ অনুসারে আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির ও বেশি। সে তুলনায় পাকা রাস্তার পরিমাণ মাত্র ২১ হাজার কিলোমিটার। এছাড়া রয়েছে রেল পথ, নদী পথ ও আকাশ পথ। তবে তুলনামুলকভাবে সড়ক পথের গুরুত্ব অধ্যাধিক বিবেচিত। বলতে গেলে বাংলাদেশের সড়ক পথ গুলো তুলনামুলক অপ্রশস্ত। অপ্রশস্ত পথে আবার যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি। যার ফলে সড়ক পথের দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে গাড়িগুলোর অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিংকে দায়ী করা হয়। পুলিশ রিপোর্টেও বলা হয় অতিরিক্ত গতি ও চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এছাড়া গাড়ি দ্রæতবেগে ব্রিজে ওঠার সময় দুর্ঘটনা ঘটার ইতিহাস অনেক রয়েছে। ওভার লোড অর্থাৎ ধারণক্ষমতার বেশি মালামাল বহন করা। ফলে চালকরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটায়।
দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা।শুধু মাত্র রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে প্রতি কিলোমিটারে ২শ ৪৭ টির বেশি গাড়ি চলে। ঢাকা মেট্রোপলিটান এলাকার আওতাধীন মোট ২২৩.৩০ কিলোমিটার রাস্তায় আনুমানিক ৫লাখ ৫০ হাজার গাড়ি চলাচল করে থাকে। অন্যান্য বড় শহরে ও অনেকটা একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। ফলে দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধিপেয়ে থাকে।
সারা দেশে যে সড়ক দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে তার জন্য এককভাবে কেউই দায়ী নয়। নানাবিধ কারণে এসকল দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। চালকদের অসাবধানতা, সরু রাস্তা, পুরনো ও ত্রটিপুর্ণ যানবাহন, প্রতিযোগিতামুলক গাড়ি চালানো, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতার অভাব, অতিরিক্ত মালামাল ও যাত্রি বহন করা, সড়কে এবং ফুটপাতের ওপর অবৈধ হাট-বাজার ও স্থাপনা। এছাড়া আইন না মানার কারনে পথচারিদের চলাচলে শৃঙ্খলার অভাব ইত্যাদি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনের জন্য সরকার ২০০৫ সালে হাইওয়ে পুলিশ নিযুক্ত করে। হাইওয়ে পুলিশের কিছু অসৎ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে । এর আগে সড়ক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য এদেশে ১৯৬১ সালের ৪ ফেব্রæয়ারি জারিকৃত এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইস্ট পাকিস্তান সড়ক পরিবহন করপোরেশন (ইপিআরটিসি) যা স্বাধীনতার পরে (বিআরটিসি) নামে পরিচিতি লাভ করে।
পরবর্তীকালে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) গঠন করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু কর্মকর্তা কর্মচারির বিরুদ্ধেও নানান অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে গাড়ির চালকদের লাইসেন্স এর ব্যাপারে। লাইসেন্স প্রদানে জালিয়াতির কারণে অনেক চালকেরই যোগ্যতা যাচাই করা হয়না।
এমন অনেক চালক আছেন যারা কোন মতে একটি লাইসেন্স যোগাড় করেই চালক বনে যায়। এযেন ভালুকের হাতে খুন্তা তুলে দেওয়ার মত অবস্থা। এ কারণেও সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরা কষ্টকর বটে।
বর্তমান সরকার বাংলাদেশে চালক ও পথচারি উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে বহুল আলোচিত ‘ সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাশ করে। নতুন এই আইনে ১৪টি বিধান রাখা হয়েছে।
সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করলে ৩০২ ধারা অনযায়ী মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সড়কে বেপরওয়া ভাবে গাড়ি চালালে বা প্রতিযোগিতা করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদনড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত করা হবে। আদালত অর্থদন্ডের সম্পুর্ণ বা অংশ বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবে। মোটরযান দুর্ঘটনায় কোন ব্যক্তি গুরুতর আহত বা প্রাণহানি হলে চালকের শাস্তির বিধান করা হয়েছে সর্বোচ্য ৫ বছরের জেল ও সর্বোচ্য ৫ লাখ টাকা জরিমানা। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ৬ মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। নিবন্ধন ছ্ড়াা মোটরযান চালালে ৬ মাসের কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। ভুয়া রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার এবং প্রদর্শন করলে ৬ মাস থেকে ২ বছরের কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
ফিটনেস বিহীন ঝুঁকিপুর্ণ মোটরযান চালালে ৬ মাসের কারাদন্ড বা ২৫ হাজারটাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। ট্রাফিক সংকেত মেনে না চল্লে ১ মাসের কারাদন্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সঠিক স্থানে মোটরযান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠা নামা না করলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বল্লে ১ মাসের কারাদন্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান, একজন চালক প্রতিবারআইন অমান্য করলে তার পয়েন্ট বিয়োগ হবে এবং এক পর্যায়ে লাইসেন্স বাতিল হবে। গণ পরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করলে ১ মাসের কারাদন্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে চালককে অষ্টম শ্রেণি পাশ এবং চালকের সহকারিকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ হতে হবে। নতুন আইনে গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। যদিও এ বিধান আগেও ছিলো কিন্তু তার কার্যকরিতা ছিলনা বলা চলে। এছাড়া সংরক্ষিত আসনে অন্য কোন যাত্রী বসলে ১ মাসের কারাদন্ড, অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ‘ সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাশ হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরানোর নামে পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তি বাড়ানোর বিরোধিতা করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান। তিনি শ্রমিকদের জন্য নতুন এই আইন নমনীয় করার দাবি জানান। তিনি সেসময় বিবিসি বাংলাকে বলেন,“ যদি সব মামলায় ৩০২ ধারা (মৃত্যুদন্ড ) রাখা হয়, ড্রাইভারকে যদি যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ঐ চালকের গরীব পরিবারের কি অবস্থা হবে? তাছাড়া আমাদের দেশে এমনিতেই লাখ লাখ ড্রাইভার কম আছে । জামিন যোগ্য শাস্তি না হলে ড্রাইভারের সংকট আরো বাড়বে। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করার দরকার। তিনি আরো বলেন, আইন কার্যকর করতে গিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শ্রমিকদের যেন হয়রানি হতে না হয়।”
নতুন এই আইনের বিরোধিতা করে মোটর মালিক- শ্রমিকেরা আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা ধর্মঘটের ডাক দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পরে অবশ্য যাত্রী সাধারণ ও মালিক শ্রমিকের সার্থসহ সার্বিক বিবেচনায় ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।
সে সময় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আইনটি কঠোর করার উদ্দেশ্য শাস্তি দেওয়া নয়, সকলের কল্যাণে সড়ককে নিরাপদ করা। তিনি সড়কের নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলার স্বার্থে সংশ্লিষ্টদের আইন মেনে চলার অনুরোধ করেন। তিনি আরো বলেন, আইন প্রয়োগের সময় অযথা যেন বাড়াবাড়ি না হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সড়ক পথে চলাচলকারি যানবাহনের চালকরাই যে শুধু দায়ী তা কিন্তু নয়। পথচারিদেরকে ও ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। এক কথায় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সড়ক পথে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব।
(লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।