মওসুমে বাজারে ধান বিক্রি করতে গেলে যে দাম পাওয়া যায় তাতে উৎপাদন খরচই উঠেনা। যে টাকা পাওয়া যায় তার প্রায় সব টাকাই শেষ হয়ে যায় কামলার মজুরী শোধ করতে আর সার, বীজ, কীটনাশকের দোকানে বাঁকী টাকা পরিশোধ করতে। ছেলে-মেয়ের, বউয়ের, পরিবারের জীবন চাহিদা মেটাতে নতুন ধান বেচে হাতে থাকেনা অবশিষ্ট। এদিকে কিস্তির টাকার জন্য বসে আছে এনজিওর স্যারেরা। কিস্তির টাকা না দিলে তারা ছাড়বেনা-দিতেই হবে। আবার গ্রামের দাদনের টাকার সুদে আসলে দ্বিগুন হয়েছে। না দিলেই পালের গরু খুলে নিয়ে যাবে মহাজন। নইলে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে হচ্ছে। কোন বাধাই মানবেনা পাওনাদারেরা। তাই ধানের চাষ ছেড়ে দিয়ে লাভজনক হিসেবে বিকল্প ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
কথাগুলি অত্যন্ত আক্ষেপের সাথে বলছিলেন বৃহত্তর চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিলসা, রুহাই, খুবজিপুর, হাসমারি, মশিন্দা, কাছিকাটা, ধারাবারিষা, শিধুলি, নাজিরপুর, রশিদপুর, মহারাজপুর, বৃচাপিলাসহ বিভিন্ন গ্রামের ভুক্তভোগী কৃষকরা। তাদের অভিযোগ, ধান বিক্রি করে বাজারে ন্যায্য দাম পাওয়া যায়না। উৎপাদন খরচও উঠেনা।
জানা গেছে, গতবছর ধানের বাম্পার ফলন হলেও বাজারে দাম না থাকায় কৃষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি একই মওসুমে বোরো ধানের চেয়ে ভুট্টা, রসুন এবং মাছ চাষে ভালো দাম পায়। তাই বোরো ধানের জমিতে বিকল্প হিসেবে বিনাচাষে ভুট্টা ও রসুন চাষসহ প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে পুকুর খনন করে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছে কৃষকরা। এমনকি উপজেলা কৃষি অফিসের মাঠকর্মিরাসহ কর্মকর্তারাও কৃষকের দাবীর সাথে একমত পোষন করছেন। কৃষকের চাহিদা বিবেচনা করে আগামি বোরো মওসুমে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করা হয়েছে দেড় হাজার হেক্টর। গম ৪ হাজার ১শ হেক্টর আর ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা গতবারের চেয়ে ২০০ হেক্টর বেশি হয়ে সাড়ে ১২শ’ হেক্টর হয়েছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন ও মৎস্য অফিসের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সালে উপজেলায় শুষ্ক মওসুমে বোরো ধান চাষ হয়েছিল সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর। ধানের দাম না থাকায় ধানী জমিতেই অধিক লাভজনক বিকল্প ফসল ভুট্টা চাষ করেছিলেন ১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে, তিনফসলী জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করা হয়েছিল ১ হাজার ৫৬১ হেক্টর এবং সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে মসলা জাতীয় রসুন চাষ করেছিলেন কৃষকরা।
গুরুদাসপুর শহরের খামারনাচকৈড় মহল্লার কৃষক হেলাল উদ্দিন বলেন, ধানের দাম কম। তাই বাজার দরে ৪ মণ রসুন ২৪ হাজার টাকায় কিনে ১১জন কামলা নিয়ে ৪৫০ টাকা করে মজুরি দিয়ে রসুন লাগাতে হয়েছে। রসুন ঘরে তুলতে এখনও ৩/৪ মাস সময় লাগবে। এরমধ্যে জমিতে সার-কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে রসুনের জমি পরিস্কারে ব্যস্ত সময় পার করছি। এক বিঘা রসুনের জমিতে ৫০ হাজার টাকা খরচ হলেও লাভবান হতে রসুনের সাথী ফসল হিসেবে বাঙ্গী চাষ করেছেন বলে জানান তিনি।
অপরদিকে উপজেলার ১৪/১৫টি ইটভাটা প্রায় ৪শ’ বিঘা তিনফসলী কৃষিজমি গিলে ফেলেছে। ফলে গুরুদাসপুরে দিনদিন ফসলি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অপরিকল্পিত যত্রতত্র পুকুর খনন করায় আবাদি জমিতে জলাবদ্ধতার কারণে সেসব জমি পানিতে ডুবে থাকছে। কোন আবাদ করা যাচ্ছেনা। যার বাস্তব প্রমান- উপজেলার বৃচাপিলা, নওদাজোয়ারী, মহারাজপুর, বৃকাশো, চাকলের বিল, হারিভাঙ্গা বিল।
আবার পুকুরে মাছ চাষ ও পুকুর পাড়ের চারপাশে পেপে, হাস-মুরগি এবং গবাদিপশু পালন করে ব্যাপক লাভবান হচ্ছে কৃষকরা। এছাড়া রসুনের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে বিনা খরচে তরমুজ, বাঙ্গি এবং করলার আবাদ করে লাভবান হওয়ায় বোরো ধান চাষে কৃষকদের অনিহার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি অফিস থেকে নানা প্রণোদনা দিয়েও ধান চাষে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছেনা কৃষকদের।
উপজেলা মৎস্য অফিস জানায়, লোকবলের সংকটের কারণে মাঠ পর্যায়ে পুকুরের হালনাগাদ সঠিক জরিপ তথ্য নাই। মৎস্য বিভাগের নিজস্ব ফর্মুলা মোতাবেক ২০১৯ সালে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর পুকুরে মাছ চাষ হয়েছে। যা ২০১৮ সালের চেয়ে ১ হাজার হেক্টর ধানি জমি পুকুর গিলেছে। আগামি শুস্ক মওসুমে যদি পুকুর খনন প্রতিরোধ করা না যায় তাহলে শষ্যভান্ডার বলে খ্যাত গুরুদাসপুর উপজেলায় দুরভবিষ্যতে ফসলি জমি হারিয়ে যাবে। তাই প্রশাসনকে এখনই ধানি জমিতে পুকুর খনন প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।