২০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার শহীদ দিবস

আজ ২০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার শহীদ দিবস। ১৯৭১ সালে জেলার জন্য সবচেয়ে শোকের, বেদনা-বিধুর এই দিনটি। সমগ্র দেশে পত্পত্ করে উড়ছিল বিজয়ের পতাকা। তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার বিভিন্ন রনাঙ্গন থেকে দলে দলে ফিরে আসছিলেন বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বিশ্রাম ও সম্মানী গ্রহনের জন্য অবস্থান নিচ্ছিলেন মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত অস্থায়ী ক্যাম্পে। ক্যাম্পের ভিতরে অনেকেই ঘুমুচ্ছিলেন, খাওয়া-দাওয়া, গল্প-গুজব, আনন্দ-উল­াস, অনেকে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, অনেকেই রনাঙ্গন থেকে মুক্তিযোদ্ধাগন কর্তৃক ফেরত নিয়ে আসা অস্ত্র-গোলাবারুদ-মাইন-ডিনামাইড ইত্যাদি গুছিয়ে রাখছিলেন, অনেকে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে নিতে ক্যাম্পের বাইরেও যাওয়া-আসা করছিলেন। যুদ্ধের তান্ডবে শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নেয়া লোকজনও শহরে ফিরছিলেন। এমনি অবস্থার মাঝে সকাল সাড়ে ৮ টা থেকে ৯ টার মধ্যে আকষ্মিকভাবে একসাথে একাধিক স্থলমাইন বিষ্ফোরিত হয়েছিল প্রলয়ংকরী বিকট শব্দে। ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়ে পড়েছিল ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত, বৃটিশ আমলে নির্মিত মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের বিশাল টিনশেড ভবন। নিমিষেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ টুকরো টুকরো হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে পেঁজা তুলার মত উড়ে গিয়েছিল। বিদ্যালয় প্রাঙ্গন, বিদ্যালয়ের চারপাশের এলাকা ও বিদ্যালয়ের বিশাল খেলার মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল মুক্তিসেনাদের ছিন্নভিন্ন মাংসপিন্ড। সে এক অভূতপূর্ব মর্মান্তিক দৃশ্য- যা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। এ দ‚র্ঘটনায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি। দ‚র্ঘটনার সময় ক্যাম্পের বাইরে অবস্থানরত যেসব মুক্তিযোদ্ধা আহত হলেও বেঁচে গিয়েছিলেন এবং এখনও যারা বেঁচে আছেন, তাদের কয়েকজনের মতে- উক্ত স্থলমাইন দ‚র্ঘটনায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দু’শতাধিক। কারো কারো মতে এ সংখ্যা আরও বেশী। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। অনেক শহীদের নাম পরিচয় আজও অজানা রয়ে গেছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন আজও বেঁচে আছেন সেই স্থলমাইন দ‚র্ঘটনার ভয়াল স্মৃতির জীবন্ত স্বাক্ষী হয়ে। স্মরনকালের এ ভয়াবহ স্থলমাইন দ‚র্ঘটনার পর মিত্রসেনা, মুক্তিসেনা ও স্বেচ্ছাসেবকরা সারাদিন ধরে খুঁজে খুঁজে কুড়িয়ে জড়ো করেছিলেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মাংসপিন্ডগুলো। মাইকিং করে জানাযা ও সৎকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের জন্য মুসলমান ও হিন্দু জনসাধারনের প্রতি আহবান জানানো হয়। আনুষ্ঠানিকতা শেষে ঐদিনই গোধুলী লগ্নে বিদ্যালয় মাঠের একেবারে প‚র্ব-দক্ষিন কোনে মাংসপিন্ডগুলোকে সমাহিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এসব শহীদদের সমাধিস্থলের সম্মুখভাগে নির্মান করা হয় শহীদ মিনার। এ শহীদ মিনারটিই মৌলভীবাজারের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। স্থাপন করা হয় এসব শহীদদের নামাঙ্কিত দুটি স্মৃতিস্তম্ভ। মাঠের একেবারে প‚র্ব-দক্ষিন কোনে, বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও স্মৃতিস্তম্ভ দুটির পৃষ্টদেশে দৃশ্যমান প‚র্ব-পশ্চিমে লম্বা প্রাচীর ঘেরা স্থানটি, স্থলমাইন দ‚র্ঘটনায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদেরই সমাধি। পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার উদ্দেশ্যেই কি এই মাইন বিস্ফোরন ঘটানো হয়েছিলো তা নিয়ে জনমনে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তবে, অনেকেই মনে করেন, ২০ ডিসেম্বর ক্যাম্পে কি ঘটেছিল ? পরিকল্পিত ভাবে হত্যা ? না কী স্রেফ দুর্ঘটনা ? মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের ৪৮ বছর পরেও তার কোন সঠিক তদন্ত হয় নি । তবে এই দিনটিকে স্থানীয় শহীদ দিবস হিসেবে এ বছর ও পালন করা হয় যথাযথ ভাবে । পৌরসভা, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠনের পক্ষ থেকে স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শহীদদের নামাঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভ যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন- শহীদ সুলেমান মিয়া, শহীদ রহিম বক্স খোকা, শহীদ আছকর আলী, শহীদ জহির মিয়া, শহীদ আব্দুল আজিজ, শহীদ প্রদীপ চন্দ্র দাস, শহীদ সত্যেন্দ্র দাস, শহীদ অরুন দত্ত, শহীদ সনাতন সিংহ, শহীদ নন্দলাল বাউরী , শহীদ কাজল পাল, শহীদ হিমাংশু কর, শহীদ আব্দুল আলী, শহীদ নুরুল ইসলাম, শহীদ আশুতোষ দেব, শহীদ তরণী দেব, শহীদ নরেশ চন্দ্র ধর, শহীদ মোস্তফা কামাল, শহীদ ইয়ানুর আলী, শহীদ ইব্রাহিম আলী, শহীদ শিশির রঞ্জন দেব, শহীদ দিলীপ দেব, শহীদ জিতেন্দ্র চন্দ্র দেব।