হাদিস শরিফে এসেছে, যখন কোনো খাদ্যদ্রব্য নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের সামনে পরিবেশন করা হত, তখন তিনি এই দোয়া করতেন,
الحمدلله الذى رزقنيه من غيرحول منى ولا قوةٍ
‘সমস্ত প্রশংসা আলাহ তায়ালার যিনি আমাকে আমা’র শক্তি সাম’র্থ্য ছাড়াই রিজিক দিয়েছেন।’ (তিরমিযী, আবুদাউদ, ইবনে মাজাহ,(আহম’দ)।
খাবার সামনে এলে নবীজির (সা.) দোয়া ও এর ম’র্মা’র্থ (পর্ব-১)
পর্ব-১ এর পর থেকে…
খানা সামনে এলে পড়ার দ্বিতীয় দোয়া: খানা সামনে এলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেকটি দোয়া পড়তেন। তা হলো,
اللهم بارك لى فيه وانعمنى خيرامنه
‘আয় আল্লাহ এই খানার মধ্যে আমা’র জন্য বরকত দান করুন, এবং আগামীতে এর চাইতে উত্তম খানার ব্যবস্থা করুন, (মেরকাত ৬/৩৬৪)।
উল্লিখিত দোয়ার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি বাক্য উপস্থাপন করেছেন। প্রথম বাক্যে বলেছেন, এই খাদ্যে আমা’র জন্য বরকত দান করুন, এদদ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আয় আল্লাহ এই রিজিক আপনার দান। যতক্ষন পর্যন্ত আপনি এর মধ্যে বরকত না দেবেন ততক্ষন পর্যন্ত এই খানা আমা’র জন্য মঙ্গল জনক হবে না, আপনি বরকত না দিলে এই খাদ্য আমা’র ক্ষুধা নিবারণ করতে পারবে না।
বরকতের অর্থ: কেননা বরকতের অর্থ হলো অল্প জিনিস কিন্তু অধিক উপকারী। তাই এখানে বরকত প্রার্থনা করা হয়েছে। অর্থাৎ আমা’র সামনে যে খাবার এসেছে, তা আমা’র ও আমা’র পরিবারের জন্য যথেষ্ট বানিয়ে দিন। এবং এদদ্বারা আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করুন। খাদ্যে বরকত না থালে অধিক খানা হলেও পেট অ’পূর্নই থেকে যায়, এ গেল বরকতের এক অর্থ।
বরকতের দ্বিতীয় অর্থ: বরকতের আরেক অর্থ হলো, এই খানা যখন দেহে প্রবেশ করবে তখন তা শক্তিও সুস্থতার অসিলা হবে, রোগ শোকের কারণ হবে না, অন্যথায় এমনও হতে পারে যে সামনে দেয়া খানা সুস্বাদু মনে করে অ’তিরিক্ত খেয়ে নিলে, ফলে বদহ’জমের কারণে বমি ও ডায়রিয়া শুরু হলো। একবার অ’তিরিক্ত খাওয়ার ফলে তিনদিন বিছানায় পড়ে থাকলে। এর অর্থ হলো খানা সুস্বাদু ছিল, স্বাস্থা সম্মতও ছিল, বরকত ছিল না। একারণেই খানা সামনে আসার পর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দোয়া করতেন আয় আল্লাহ আমি জানি এই খানা আপনার দান। এবং বহু বড় নেয়ামত। কিন্তু এই নেয়ামত সেই সময় উপকারী হবে, যখন আপনি বরকত দেবেন, তাই আমি আপনার কাছে ভিখেরির মত এই প্রার্থনা করছি, আয় আল্লাহ এই খাদ্যে আমা’র জন্য বরকত দান করুন।
বরকত তালা’শ কর: বিভিন্ন হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খানার মধ্যে বরকত তালা’শ করার জন্য তাগিদ প্রদান করেছেন, এবং বলেছেন তোম’রা যখন খানা শুরু করবে তখন
بسم الله وعلى بركةالله
(আল্লাহ তায়ালার নামে শুরু করছি এবং আল্লাহ তায়ালার বরকত প্রার্থনা করছি) বলবে। (তাফসিরে সাআলাবী)
অনুরূপভাবে খানা খাওয়ার সময় যদি আঙুলে খানা লেগে থাকে তা হলে খানা শেষ করার পর আঙুল চেটে খাবে কিংবা অন্য কাউকে খাইয়ে দেবে। এদ্বারা আল্লাহ তায়ালার দেয়া রিজিকের ও নেয়ামতের অবমুল্যায়ন করা হয় না। কেননা সাধারণত আঙুলে কিছু না কিছু খাবার লেগেই থাকে। এই অবস্থায় যদি হাত ধুয়ে ফেলা হয়, তা হলে খাবারের অসম্মান ও অবমূল্যায়ন করা হবে।
আঙুল চাটার মধ্যে বরকত: আঙুল চাটার আকেটি ফায়েদা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোম’রা জান না, তোম’দের খাবারের কোন অংশে বরকত রয়েছে। হতে পারে যেই খাবার তোম’রা খাচ্ছ তাতে কোনো বরকত নেই । কিন্তু খাবারের যে অংশ তোমাদের আঙুলে লেগে আছে, আল্লাহ তায়ালা তাতেই বরকত রেখেছেন। এ কারণেই বলা হয়েছে, আঙুল চেটে খাও।
তিন আঙুলে খাওয়া: হ’জরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচ আঙুল ডুবিয়ে খানা খেতেন না । তিনি বরং সব সময় তিন আঙুলে খানা খেতেন, ছোট ছোট লোকমা নিতেন। অবশ্য সেযুগের খাবার সাধারণত শুকনো জাতীয় জিনিস হত। মোট কথা, খানা সামনে এলে সর্বপ্রথম তিনি বরকতের দোয়া করতেন।
এর চেয়ে উত্তম খাবার দিন: আলোচ্য দোয়ার দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়েছে, وانعمنى خيرامنه আয় আল্লাহ আমাকে এর চেয়ে উত্তম খাবার দান করুন, কেননা আম’রা আপনার দান ও দয়ার পরম অনুগত। আল্লাহ তায়ালার কাছে মুখাপেক্ষী হয়ে প্রার্থনা করবে। দাসত্বের দাবিও হলো, মানুষ আল্লাহ তায়ালার কাছে মোহতাজ ও মুখাপেক্ষী বান্দার মতো করে প্রার্থনা করবে।
হ’জরত আইয়ুব (আ.) এর ঘটনা: বোখরী শরিফে হ’জরত আইয়ুব (আ.) এর ঘটনা এসেছে, একবার তিনি গোসল করছিলেন। এমন সময় তার ওপর স্বর্নে তৈরি প্রজা’পতি পড়তে লাগল। ফলে তিনি গোসল রেখে সেগুলো কুড়াতে শুরু করলেন। এমন সময় আল্লাহ তায়ালা বলনে, আইয়ুব, আমি তোমাকে প্রথম থেকে বহুত ধরনের নেয়ামত দান করেছি। এর পরও তুমি স্বর্ণের পেছনে দৌঁড়াচ্ছ? হ’জরত আইয়ুব (আ.) উত্তর দিলেন, আয় আল্লাহ নি:সন্দেহে আপনি আমাকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। আমি সে সবের শোকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারব না। কিন্তু আপনি যখন আরো দান করছিলেন, আয় আল্লাহ আপনি যখন আরো দান করছিলেন আয় আল্লাহ, আপনার দেয়া বরকত ও নেয়ামত থেকে অমুখাপেক্ষী থাকতে পারি না, আপনি যেহেতু দিচ্ছেন, তাই আমি নিজেকে তার মুখাপেক্ষী মনে করে সেগুলো সংগ্রহ করে নিচ্ছি। لاغنى بى عن بركتك আমি আপনার বরকত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি না। কারণ আমি আপনার মুখাপেক্ষী।
মাথা যেন খা’রাপ না হয়: সুতরাং এমন যেন না হয় যে, কারো সামনে উত্তম ও সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করা হলো, তখন তার মাথা খা’রাপ হয়ে যায় আর ভাবতে থাকে আমি বোধ হয় সর্বশ্রেষ্ট খাবার পেয়ে গেছি। এখন আমা’র আর অন্য খাবারের প্রয়োজন নাই। দোয়ার এই অংশটুক এ জাতীয় চিন্তা ভাবনার ওপর ইতি টেনে দিয়েছে। এ সময় বরং ভাববে, আপনি যা কিছু দান করেছেন, নি:সন্দেহে তা অনেক বড় নেয়ামত। এই নেয়ামতের শোকর আদায় করা আমা’র পক্ষে সম্ভব না, তবে এখনো আমি আপনার দান দক্ষিনার মুখাপেক্ষি। তাই আপনার সমীপে আমা’র প্রার্থনা হলো, আয় আল্লাহ আমা’র জন্য আরো উত্তম খানার ব্যবস্থা করুন।
সার কথা: এখন চিন্তার বিষয় হলো, যে ব্যক্তি খানা সামনে আসার পর, খাওয়া শুরু করার পূর্বে এই স্বীকার করে যে, আয় আল্লাহ এই খানা আপনার দান, এজন্য আমি আপনার প্রশংসা করছি। এর মধ্যে আমা’র শক্তি সাম’র্থ্যের এতটুকু দখল নেই, আয় আল্লাহ আমি আপনার কাছে এই খাবারের বরকত প্রার্থনা করছি এবং ভবিষ্যতে এর চেয়ে উত্তম খাবার আশা করছি। আল্লাহ তায়ালা কি এই খাবারের মাধ্যেমে তার ভিতরে নুর সৃষ্টি করে দেবেন না? এমন ব্যক্তির পানাহারের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবশ্যই বরকত আসবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এই দোয়া পড়ার তাওফিক দান করুন, আমিন।