‘‘জীবনের দিনগুলো’’ পান্ডুলিপির পাতা থেকে— চোর ধরার খেসারত

     সে সময় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  আহবানে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ হতে যখন সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের মত পাবনা জেলাতেও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তখন ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’কে আরো শক্তিশালি করে গড়ে তোলার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন কল্পে একাধিকবার পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বলিষ্ঠ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল আমাদের এলাকায় আসেন এবং আমাদের সহযোগিতায় ছাত্র ও যুব সমাজকে চাঙ্গা করে রাখেন।

এরই মধ্যে একটি অযাচিত ঘটনা ঘটে গেল। আর তা হলো আমাদের গ্রাম সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের বাদলপাড়াতে মধু ডাকাত নামে এক ডাকাতের বাস ছিলো। সেই মধু ডাকাতের মৃত্যুর পর তারই এক ছেলে বিল্লাল চোর ওরফে বিরাদ চোর নামে এক ব্যক্তি গৃহস্তের বাড়িতে মাটির উচু ভিটার ডোয়ায় রাতের বেলা সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে চুরি করতো। কথায় বলে ‘ দশ দিন চোরের আর একদিন সাধুর’। ভাগ্যক্রমে ঘটলোও তাই।
৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখে রাতের বেলা বিল্লাল চোর গ্রামের মক্কেলের বাড়িতে সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে এক বস্তা হলুদ চুরি করতে গিয়ে গৃহস্বামীর হাতে ধরা পড়ে। এছাড়া পাশের গ্রাম সমসপুর হতে সে আগের রাতে কিছু কাঁসার থালা বাটি চুরি করে একটি আখের জমিতে রেখে দেয়। তাকে মালামাল শুদ্ধ গ্রামের মাতব্বর বা গ্রাম প্রধান নজির ডাক্তারের বাড়িতে নিয়ে বেদম মারপিট শুরু করে। বেলা যতই বাড়তে থাকে লোক সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। যে আসে সেই মারে। বল শালা আর কেথায় কোথায় চুরি করেছিস। বল। মারের যেন মহোৎসব চলতে থাকে। নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে মারতে মারতে এক সময় সে পরনের কাপড় ভরে পেসাব পায়খানা করে ফেলে। তার নাক-মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখে যারা তাকে বেদম মেরেছিলো তারা ক্রমে ক্রমে সরে পড়তে থাকে।
এমনি করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়। এর মধ্যে অনেকেই বলে থানায় খবর পাঠাও। দারোগা-পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যাক। কিন্তু থানায় যাবার সাহস কারো হয়না। এক পর্যায়ে লোকজন সকলেই যে যার মত সটকে পড়ে। তখন গ্রাম্য প্রধান শুধু হায় হায় করতে থাকে। নজির ডাক্তার একসময় তার ছেলে আফফান, শ্রীকৃষ্টপুরের মুক্তার আলী এবং আমাকে খুবই অনুরোধ করে তাকে প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে এবং থানায় জানাতে।
আমরা তিনজন তখন এলাকার শিক্ষিত এবং সাহসি যুবক। তাই বাধ্য হয়ে সেই মূমুর্ষ বিল্লাল চোরকে প্রথমে নৌকায় রূপপুর পর্যন্ত এবং রূপপুর হতে একটি রিকসা জোগাড় করে তাকে রিকসার উপর কোন মতে বসিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে রিকসাওয়ালাসহ আমরা তিনজন রিকসা ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলাম। চুরির মালামালসহ চোরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর রটে গেছে। ততক্ষণে চোর দেখার জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে নারী-পুরুষের ভীড়। সকলেই আমাদেরকে খুবই বাহবা দিতে থাকে। আসলেও আমরা কাজের মত একটা কাজ করেছি বটে।
কিন্তু পাবনা সদর থানায় তাকে নিয়ে গেলে ফলাফল উল্টো দিকে ধাবিত হলো। থানার মাঠে পৌঁছামাত্র বিল্লাল চোর গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। সে রিকসা থেকেই হাউ মাউ করে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। ও স্যার আপনেরা আমাকে বাঁচান স্যার। এরা আমাকে মারতে মারতে মেরে ফেলে দিবে স্যার। তার এমন অভিনয়ের চিৎকার চেচামেচিতে থানা থেকে দারোগা ছুটে এলেন। পথচারিরা ভিড় করতে লাগলো। বিল্লাল শুধু বলেই চলেছে স্যার আমি একজন ভালো মানুষ স্যার আমাকে ওরা চোর সাজিয়ে কিছু হলুদ এবং থালা বাসন আমার সঙ্গে দিয়ে আমাকে মারপিট করেছে। এই দেখেন মাইরে মাইরে আমারে কি অবস্থা করে ফেলেছে স্যার। এমন কান্নাকাটি চিৎকার চেচামেচি শুনে সকলেই বলা বলি করতে লাগলো আহারে মানুষকে কি কেউ এভাবে মারে। বিল্লাল আরো জোরে জোরে বলে আল্লার কিরে স্যার, খোদার কসম স্যার আমি চোর না। স্যার আমি জীবনেও কোন দিন চুরি করি নাই স্যার। ইরা আমাকে কিভাবে মাইর দিছে দ্যাহেন স্যার বলে নিজের লুঙ্গি খুলে ফেলতে থাকে। পুলিশ তাকে ধমক দেয় থাম বেটা আমরা দেখছি। সে বার বার বলেই চলেছে, স্যার এদের বিচার করেন স্যার।
কি করতে কি হয়ে গেল একজন পাকা সিঁদেল চোর যার নামে এই থানাতেই অনেক রিপোর্ট রয়েছে। চোরদের তালিকায় শীর্ষে যার নাম রিপিবদ্ধ রয়েছে, সেই কিনা পুলিশের কছে সাধু আর আমরা সেই চোরকে ধরে এনেই পড়লাম মহা বিপদে। আমরা তখন এমন অসহায় যে কিছুই ভেবে পাচ্ছিলামনা। এমন যে অবস্থা হবে তা রাতে আমরা কেউ খোয়াবেও দেখিনি। একটার পর একটা প্রশ্নের সম্মুখিন হচ্ছি আমরা। আমাদেরকে দারোগা পুলিশ জেরা শুরু করে দিলো। এমন সময় থানার বড় বাবু অর্থাৎ ওসি সাহেব এসে হাজির হলেন। তাকে আসা দেখে বিল্লাল চোরের চিৎকার এবং আহাজারির পরিমাণ আরো বেড়ে গেল। ওসি সাহেব সব কিছু ভালো করে শোনার আগেই বলে দিলেন, এই লোকটাকে যারা অন্যায়ভাবে মেরেছে সেই শালাদেরকে আগে লকাপে ঢুকাও। আমরা কিছু বলার আগেই তিনি স্থান ত্যাগ করলেন। আমরা আরো অসহায়ত্ব বোধ করতে লাগলাম।
কথায় বলে বাঘে ছুইলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুইলে ছত্রিশ ঘা। আমাদের ও যেন সেই দশা। ততক্ষণে তিনজন সিপাই এসে আমাদেরকে টানাটানি শুরু করে দিলো। চলেন আপনাদেরকে লকাপে যেতে হবে। তখন বাধ্য হয়ে আমরা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলাম চলেন কোথায় যেতে হবে চলেন, ওসি সাহেব কোথায় গেলেন তার কাছে চলেন। সিপাইরা বলে স্যার আপনাদেরকে লকাপে ঢুকাতে বলেছে ,লকাপে চলেন এত কথা কিসের। মুক্তার আলী ততক্ষণে গর্জে উঠে বলে চল বেটা তোর লকাপ কোথায় চল। বলতে বলতে ওসির চেম্বারে ঢুকে পড়লেন। আমরাও পিছু নিলাম। তখন তিনি রাগতভাবে বলেন আপনিকি আমাদেরকে চেনেন, আমরা কারা। আপনি আমজাদ চাচা (আওয়ামী লীগ নেতা ও এম এন এ), বগা চাচা (আব্দুর রব বগা মিয়া), আর উদ্দিন ভাইকে ওয়াজি উদ্দিন খান, আওয়ামী লীগ নেতা) কে টেলিফোন করে জিজ্ঞাসা করেন আমরা কারা?
কথায় বলে জোঁকের মুখে লবন দেয়া। মূহুর্তের মধ্যে অন্য রকম ঘটনা ঘটে গেল। যেন গরম তেলের ভান্ডের উপর বরফের চাঁই কেউ ফেলে দিলো। তিনজন নেতার কথা বলাতেই আঁতকে উঠলেন ওসি সাহেব। কি বল্লেন আপনারা উনাদের লোক? একথা আগে বলবেন তো।
সময়টা ছিলো এমন যে, থানাসহ সকল প্রশাসন তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে চলতো। কারন তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে সারা দেশে হরতাল পালিত হচ্ছিল, চলছিলো অসহযোগ আন্দোলন। আমরা তখন ছাত্র লীগের নেতা। থানার সকল ষ্টাফই তখন পাবনার আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ সাহেব, আমিন উদ্দিন, আব্দুর রব বগা মিয়াদের নিয়ন্ত্রনে। এসব কথা বলতে বলতেই বগা মিয়া ও রফিকুল ইসলাম বকুলসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ নেতা সেই্সময় হঠাৎ করে থানায় এসে হাজির হলেন। আমরা মহান আল্লাহর কাছে অশেষ শোকর গুজার করতে লাগলাম। যদি তারা না আসতেন তবে আমাদের দফা রফা হয়ে যেতো। আমরা বগা চাচা ও বকুলকে ঘটনা খুলে বলতে গেলে কথা কেড়ে নিয়ে ওসি সাহেব বলতে লাগলেন, স্যার ইনারা এক চোরকে ধরে নিয়ে এসেছে। আসলে এই যুবক শ্রেণী আছে বলেইতো দেশ ঠিকমত চলছে। আরো সব প্রশংসা সুচক কথাবার্তা বল্লেন। আমরা তখন একেবারে থ হয়ে গেছি। বেটা এতক্ষণ কি বলেছে আর এখন কি বলছে। আসলে ঠেলার নাম বাবাজি একেই বলে।
এদিকে বিল্লাল চোরকে চিকিৎসার জন্য ততক্ষণে শালগায়িায় অবস্থিত পাবনা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ওসি সাহেব আমাদেরকে স্বাক্ষীর খাতায় নাম লেখালেন। আমাদের কাছে চোরকে শায়েস্তা করার জন্য সাহায্য সহযোগিতা চাইলেন যাতে আমরা থানাকে সাহায্য করি। আমরাও নাছোড় বান্দা। বল্লাম আমরা মালিগাছা যাবো এখনতো অনেক রাত। আমরা কোন গাড়ি পাবনা, আমাদের যাবার ব্যবস্থা কি হবে? বলতেই ওসি সাহেব বল্লেন আপনাদেরকে মালিগাছা পর্যন্ত থানার গাড়িতে করে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে। আমাদেরকে চা খাওয়ানো হলো নেতাদের সঙ্গে। সত্যি সত্যিই ওসি সাহেব আমাদের যাবার জন্য থানার একমাত্র লক্কর-ঝক্কর মার্কা জিপ গাড়ি দিলেন। আমাদের নাম ধাম আগেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো আসামির খাতায়। এবার লেখা হলো স্বাক্ষীর খাতায়। তাই আদর যতœ তো করতেই হবে। এদিকে ঘটেছে আরেক কান্ড। আমরা এলাকার তিনজনই শিক্ষিত যুবক এবং নেতা পত্তনের। এলাকার লোকজন আমাদেরকে খুবই ভালোবাসে। তাই তাদের কাছে কে বা কারা খবর দিয়েছে যে, আমাদের তিনজনকেই থানা হাজতে আটক করে রাখা হয়েছে। তাই তারা ব্যাকুল হয়ে হয়ে কয়েকশো লোক মালিগাছা কাঠের শাঁকোর কাছে একত্রিত হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কারো পক্ষেই থানায় গিয়ে খোঁজ খবর নেয়া সম্ভব নয়। যদি তাদেরকেও ধরে থানায় আটকে রাখা হয়।
যাক এদিকে রাতের বেলা যখন পুলিশের গাড়ি এসে মালিগাছা কাঠের শাঁকোর কাছে থেমেছে তখন সকলেরই ধারণা যে পুলিশেরা আরো লোকজনকে ধরতে এসেছে। তাই তারা যে যেভাবে পারে ঢিলের জমির মধ্য দিয়ে রাতের আাঁধারে গা ঢাকা দেয়। কিন্তু আমরা যখন গাড়ি থেকে নামি তখন হেড লাইটের আলোতে আমাদেরকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে দলবদ্ধভাবে আমাদের কাছে এসে হাজির। সকলেই বলতে লাগলো আমরা তোমাদেরকে এগিয়ে নিতে এসেছি, কিন্তু তোমাদের এ্যারেষ্ট করার খবর শুনে আমরা এখানে অপেক্ষা করছি …….।
(লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।