ঝিনাইদহের শৈলকুপায় বেড়েছে কিশোর অপরাধ। এরই মধ্যে সংঘটিত হয়েছে একটি খুন ও বেশ কিছু ছিনতাইয়ের ঘটনা।
খোজ নিয়ে দেখা যায়, যারা এ অপরাধের সাথে জড়িত তাদের বেশীরভাগ কিশোর বয়সের। এছাড়া শহরের বিভিন্ন মহল্লায় উঠতি বয়সের যুবকরা সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে গান ও আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যবহার করা এক ধরনের বিশেষ হরণ মটরবাইকে লাগিয়ে সন্ধার পর থেকে ভিতিকর অবস্থার সৃষ্টি করছে বলে জানা যায়। কিছু বললে বখাটে কিশোরদের চোখ রাঙানির সম্মুখিন হতে হচ্ছে বলে সুশিল সমাজের অভিযোগ। এছাড়া কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকায় শৈলকুপা বাজার সহ বিভিন্ন বাজারে ও গ্রামাঞ্চলের টি স্টলে কেরাম খেলার ব্যবস্থা ও কিশোরদের ধুমপানের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে সুশিল সমাজের ধারনা স্কুলগামী কিশোরদের হাতে দামি মোবাইল ও প্রযুক্তির অপব্যবহারে তারা জড়িয়ে পরছে খুন ছিনতাই সহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকদের অসচেতনতার কারনে বিপথগামী কিশোররা নেশার টাকা জোগাড় করতে চুরি সহ জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপকর্মে।
এসব ঘটনা নিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে সাথে কথা হলে তিনি বলেন যারা এসব কথা বলছে তাদেরকে থানায় এসে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন।
জানা যায় উপজেলার সাদেকপুর গ্রামে চলতি মাসে প্রথম সপ্তাহে বুধবার রাত ৮টার দিকে জুয়েল নামের অষ্টম শ্রেনীর এক ছাত্রকে কুপিয়ে হত্যা করে তার একই ক্লাসের বন্ধ রাতুল। নিহত জুয়েল শেখ(১৫) স্থানীয় বেনীপুর হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র এবং সাদেকপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। বুধবার রাতেই পুলিশ হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে তার দুই বন্ধু রাতুল জোয়াদ্দার ও সাগর শেখকে আটক করে। তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক তাদের কাছ থেকে রক্ত মাখা জামা কাপড় ও হত্যায় ব্যবহৃত দা উদ্ধার করে বলে জানা যায়। আটক রাতুল সাদেকপুর গ্রামের রেজাউল জোয়াদ্দারের ছেলে ও বেনীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র এবং সাগর একই গ্রামের রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে। এ ঘটনায় আটক রাতুল ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে বলে জুয়ল তার ছোট ভাই মেহেদী ও তাকে মারার প্রতিশোধ নিতেই সে জুয়েলকে কুপিয়ে হত্যা করে। সাদেকপুর গ্রামের দোকানদার তরিকুল ইসলাম বলেন, সন্ধার আগে জুয়েল ও রাতুল তার দোকানে কেরাম খেলতে আসে। মাগরিবের আজানের সময় বিদ্যুতের লোডসেডিং হলে রাতুল জুয়েলকে নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এরপর রাত আটটার দিকে জানতে পারি মাঠের বিলে জুয়েলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। খোজ নিয়ে জানা যায় তারা সবাই গাজা সহ বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত এবং রাতে গ্রামের বিভিন্ন গাছের ফল সহ নারিকেল সুপারি চুরির সাথে জড়িত।
এছাড়া ছিনতাই আতংক বিরাজ করছে শৈলকুপার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে। সন্ধার পরপরই এক শ্রেনীর উঠতি যুবক বিভিন্ন গ্রাম্য সড়কে মটরসাইকেল ব্যবহার করে পথচারীদের মোবাইল সহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে অবাধে পালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। ৩নং দিগনগর ইউনিয়নের গোকুলনগর, দহকোলা, কৃষ্ণনগর, হারুন্দিয়া, ৭নং হাকিমপুর ইউনিয়নের নাকপাড়া, ১৩নং উমেদপুর ইউনিয়নের বারইপাড়া গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে এলাকাবাসি জানান। কোরবানীর ঈদের পরপরই এ ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পায় বলে তারা বলেন। এ ধরনের একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনায় যে কোন সময় প্রাণহানী ঘটতে পারে বলে ক্ষতিগ্রস্থদের আশংকা। এলাকাবাসির সাথে কথা বলে জানা যায় যারা এ অপরাধের সাথে জড়িত তাদের প্রত্যেকের বয়স ১৫ বছর থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
গোকুলনগর গ্রামের মধু বিশ্বাসের ছেলে শিহাব বিশ্বাস জানান, তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি তার মোবাইলে একটি এ্যাপস ডাউনলোড করে আউটসোর্সিং এর কাজ করে থাকেন। কিছু দিন আগে রাত নয়টার দিকে তার ঘরের মধ্যে নেটিং অবস্থা একটু দুর্বল হওয়ায় তিনি মোবাইলটি নিয়ে বাড়ির সাথেই রাস্তায় আসেন। রাস্তায় দাঁড়াতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি মটরসাইকেলে ১৫/১৬ বছরের দুই যুবক তার মোবাইলটি হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তমালতলার দিকে চলে যায়। তাদের পিছনে একটি ব্যাগ ছিল। তিনি আশংকা প্রকাশ করেন দ্রæত এটি নিয়ন্ত্রনে না এলে ছিনতাই কাজে বাধা দিতে গেলে যে কোন সময় প্রানহানী ঘটতে পারে। ঈদের পর থেকে এ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে তিনি জানান। তিনি স্থানীয় থানায় একটি দরখাস্ত দিয়েছেন বলে আরো জানান।
দহকোলা মোড়ের মুদি দোকানী মধু জোয়াদ্দার বলেন, অব্যাহত ছিনতাইয়ের ঘটনায় তারা খুব আতংকের মধ্যে আছেন। সন্ধার পরপরই তারা মোবাইল সহ কোন জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় যেতে ভয় পান । রাস্তায় একটু দাঁড়িয়ে থাকলেই মটরসাইকেল যোগে ছিনতাইকারীরা তা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তিনি জানান তার এলাকার কিবরিয়া ডাক্তারের ছেলে বাবুল হোসেনের মোবাইল, শহীদুল মোল্যার ছেলে শাহীন মোল্যার মোবাইল, শিহাবের মোবাইল সহ আরো অনেকের মোবাইল ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করে পালিয়ে যায়। পৌর এলাকার বালিয়া ডাঙ্গা গ্রামের আনিচুর রহমান বলেন কিছুদিন আগে রাতে ৭ নং হাকিমপুর ইউনিয়নের নাকপাড়া গ্রামের রবি হোসেনের ছেলে সুমন হোসেনের একটি দামি মোবাইল দুই ছিনতাইকারী ছিনিয়ে নিয়ে মটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। তাছাড়া দিগনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামবাসির সাথে কথা বলে জানা যায় এলাকার অচিন্তপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় এলাকায় সন্ধার পর বিক্রি হয় গাজাসহ বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য। যার ক্রেতা বিভন্ন এলাকার উঠতি বয়সের যুবক। তারা ভয়ে কিছু বলতে পারছে না।
এ অপরাধ নিয়ে শৈলকুপা পাবলিক হল ও লাইব্রেরীর সাধারন সম্পাদক স্বপন কুমার বাগচী বলেন রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা ও অসুস্থ সামাজিক রাজনীতি সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কিশোর অপরাধী। সেই সাথে মিডিয়ায় প্রচারিত বড় শহরগুলোর কিশোর গ্যাং এর সংবাদও উৎসাহিত করছে কিশোরদের। এখনি পদক্ষেপ না নিলে সাংস্কৃতিকভাবে অনগ্রসর শৈলকুপায় ভবিষ্যতে সামাজিক নৈরাজ্যসহ ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। গতানুগতিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সামাজিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনকে নির্মোহভাবে কাজ করতে হবে। কারণ সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হলে কারও কিশোর সন্তানই নিরাপদ থাকবেনা।
কিশোর অপরাধ নিয়ে শৈলকুপা সুশিল সমাজের আহবায়ক ঝিনাইদহ জর্জ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর ইসমাইল হোসেন বলেন, স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার অভাব, তাদের হাত দামী মোবাইল আর এসব মোবাইলে প্রযুক্তির অপব্যবহার কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে অভিভাবকদের অসচেতনতায় কিশোররা জড়িয়ে পরছে বিভিন্ন অপরাধে, আসক্ত হচ্ছে নেশায়। তারা নেশার টাকা জোগাড় করতে পা বাড়াচ্ছে অপরাধ জগতে। এরই মধ্যে এক স্কুল ছাত্র তার সহপাঠিকে খুন করেছে। তিনি বলেন সামাজিক শিক্ষা ও আইনশৃংখলা সম্পর্কে বিপথগামী কিশোরদের যদি আমরা সচেতন করতে না পারি তাহলে সবাইকে এর খেসারত দিতে হবে।
শৈলকুপার কিশোর অপরাধ নিয়ে থানার ভারপ্রপ্ত কর্মকর্তা বজলুর রহমান বলেন, যদি কোন ব্যক্তি এ ধরনের কোন ঘটনা নিয়ে আমাদের কাছে আসে তাহলে তাকে যেন আমরা থানায় পাঠিয়ে দি। তারপর তিনি ব্যবস্থা নিবেন।