॥ আবদুল জব্বার ॥
চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে সরকারের এক বছর পূর্ণ হবে। একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন বা ভোট কি ধরনের হয়েছে নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞাতার মধ্য দিয়ে তা মানুষ অনুভব করতে পেরেছে। দেশের মানুষকে এ বিষয়ে বলার বা বুঝানোর কোনো প্রয়োজন নেই। দেশের সাধারন মানুষ জানতে চায় কেন তাদের ভোটাধিকার বারবার ছিনতাই হয়ে যায় । এখন একটাই প্রশ্ন এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি ?
বর্তমান সময়ে সামাজিক নৈরাজ্য কোনো মতেই থামছেনা, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মধ্যে ধর্ষণ, খুন, রহাজানি, টেন্ডার বাজি, চাঁদাবাজি, শিশু পাচার, নারী পাচার অব্যাহত রয়েছে। লাঞ্ছনার কারণে নারীদের আত্মহত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক সময় নির্যাতিত হয়েও থানায় অভিযোগ দিতে গিয়ে পূনরায় বিপদে পড়ার আশংকায় অনেকে নির্যাতন সহ্য করেও নিরব থাকেন। স্বাধীন দেশে এ রকম পরিস্থিতি কারোও কাম্য হতে পারে না।
দেশের মধ্যে ভয়াবহ মাদক ব্যবসা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথে মাফিয়া রাজনীতিবিদ, সামাজিক দুর্বৃত্ত ও প্রশাসনের একাংশ জড়িত। পরিবহন সেক্টরে চলছে চাঁদাবাজি, সড়কে মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত আছে। আইনের শাসন নেই। ত্বকী হত্যা, সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি হত্যা, তনু হত্যার বিচার এখনও হয়নি। বন্ধ হয়ে আছে থমকে আছে অনেক মামলা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্বিত। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিপর্যস্ত। রাষ্ট্র-প্রশাসন-বিচার বিভাগ এমকি সংসদের উপরও কর্তৃত্ব করছে নির্বাহী বিভাগ। সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাস্তবায়নের নির্দেশদাতা হয়ে গেছেন নির্বাহী বিভাগের প্রধান-প্রধানমন্ত্রী। দেশের সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীকে দেখভাল করতে হয়। মানুষ সব সমস্যার সমাধান প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশা করে। তবে এটি একটি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কর্মকান্ড হতে পারে না।
২০১৪-২০১৮ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে বর্তমান শাসকদল নির্ভর করেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর। যা এদেশের মানুষ দেখেছে। তাই রাষ্ট্রের উপর এবং জাতীয় স্বার্থ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সারকারি দলের হাতে নিরুঙ্কুশ আছে বলে মনে হয়। তাই আমরা দেখি আসামের এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি, তিস্তার পানি, সীমান্ত হত্যা নিয়ে সরকার নিশ্চুপ। বর্তমান সরকারী দলের শক্তি যদি জনগণ হতো তাহলে এরকম হতো বলে মনে হয় না। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, মিসেস গান্ধী আপনার সেনাবাহিনী আপনি কখন আমার দেশ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন? এই কথা বঙ্গবন্ধু বলতে পেরেছিলেন কারণ তাঁর পায়ের তলায় মাটি ছিল শক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিদেশনীতির এই অবস্থার জন্য বিরোধী দলের দেউলিয়াত্ব ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিও কম দায়ী নয়। আমরা দেখেছি শাসকশ্রেণির দুই দলের দ্বন্দ্বের রাজনীতিকে বিদেশি শক্তিগুলি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এর ফলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে একটু বলে রাখা উচিৎ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতীয় জনগণের ও সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতা ও আত্মত্যাগ আমাদের দেশের মানুষ কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে।
পরপর তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকারী দল আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ছাত্র লীগ সহ গণসংগঠনের নেতা কর্মীদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রধান নেতৃত্বে থাকা রাজনৈতিক দলটির একশ্রেণির নেতাদের অবৈধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকার ঘটনা বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রতিদিন মানুষ জানতে পারছে। সম্প্রতি ক্যাসিনো কেলেংকারির ঘটনায় আওয়ামীলীগ যুবলীগের অনেকেই জড়িত।
এ দলটিতে সুযোগ বুঝে ইতিমধ্যে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী নেতাদের আনুকুল্য পেয়ে বিএনপি-জামায়াত-শিবির এমনকি ফ্রিডম পাটির নেতারাও যোগদান করেছেন। বর্তমানে বহিরাগতদের অনুপ্রবশে আক্রান্ত আওয়ামীলীগ।সম্প্রতি একাধিক জাতীয় দৈনিকে তথ্য সম্বিলিত এ সমস্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ফেনীর সোনাগাজির জামায়াত নেতা সিরাজউদ্দৌলা কীভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে? ফ্রিডম পার্টির এক সময়ের প্রভাশালী নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া কিভাবে যুবলীগের নেতা হয়েছে। বাহিরাগত স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি কিভাবে এবং কাদের ছত্রছাঁয়ায় আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে। এরকম অনাকাংখিত ঘটনাগুলোর নেপথ্যের নায়কদের খুঁজে বের করতে হবে। প্রধান মন্ত্রী চলমান সংকট থেকে উত্তীর্ণ হবার জন্য দূর্নীতিবাজ মাদক ব্যবসায়ী জঙ্গিবাজ ও সন্ত্রাসের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করার জন্য দেশের আইন শৃক্স্খলা বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য দলের সিদ্ধান্ত না মেনে যে সব এমপি মন্ত্রীরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন নির্বাচনে তাদের সমর্থিত প্রর্থীদের মদত দিয়েছিলেন । বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্যের সুত্র মতে জানা গেছে, দেড়শত এমপি মন্ত্রী এবং নেতৃবৃন্দের সকল রকম দূনীতি ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের ফাইল এখন প্রধান মন্ত্রীর হাতে। এখন হার্ডলাইনে প্রধান মন্ত্রী। এ সমস্ত ঘটনায় জড়িত নেতাদের ইতিমধ্যে দল থেকে শোকজ নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া আওয়ামী লীগের মূলমন্ত্র। মানুষের এই মন্ত্রে উজ্জীবিত করেই গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ দলটি। কিন্তু ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগ যেন একশ্রেণির নেতা কর্মীর দূর্নীতি অনিয়ম উচ্ছৃংখলতার জাঁতা কলে বন্দি হয়ে পড়েছে। দলের মধ্যেকার অসৎ ও লোভী এসব নেতা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে জলাঞ্জলি দিচ্ছে দল ও দেশের স্বার্থ। তারা যে কোন মূল্যে অবৈধ উপায়ে অর্থবৃত্ত লাভ করে সমাজের মধ্যে একটা অস্থিরতা ও বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এর বিপরীতে যারা দীর্ঘদিন ধরে দলের আদর্শ লালন করে সৎভাবে রাজনীতি করছেন তারা হয়ে পড়েছেন কোণঠাসা।
সম্প্রতি ক্যাসিনো কেলেংকারির ঘটনায় দলের অনেক নেতার মূখোশ উম্মোচিত হয়েছে। চলমান শুদ্ধি অভিযানে যারা ধরা পড়ছে তাদের একটা অংশ আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী। বর্তমানে এ সব অনুপ্রবেশকারীতে আক্রান্ত আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী প্রভাবশালী নেতাদের মাধ্যেমে দলে প্রবেশ করে ক্যােিসনো কেলেংকারি , টেন্ডার বাজি, সন্ত্রাস এবং দূর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন তারা। এসব টাকার বড় অংশই তারা পাচার করছে বিদেশে। .
দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিগত সামরিক শাসনামলের সকল অধ্যাদেশ অবৈধ্য ঘোষণা করেছেন। তা হলে ৭২’এর সংবিধানে ফিরে যাবার বাধাটা কোথায়? দেশের মধ্যে যতো উন্নয়নই হউক না কেনো স্বাধীন দেশের গণতন্ত্রহীনতা কারো কাম্য নয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা এক সূত্রে গাঁথা। অতীতে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে না পারার কারণে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বর্তমান সময়ে সকল রকম অন্যায় ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের পদক্ষেপকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল সহ দেশের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ ইতিবাচক দেখছেন। এমতাবস্থায় জাতীয় স্বার্থে দল মত নির্বিশেষে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলোর সর্বাত্মক ঐক্য অতীব জরুরি। সকল রকম অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশবাসীকে সাথে নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অপশক্তি গুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানের এখনই উপযুক্ত সময়। দেশের সকল রাজনৈতিক সচেতন মানুষকে স্মরণ রাখতে হবে সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। লেখক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকার কর্মী । ই – মেইল zabbar.pabna@gmail.com
আবদুল জব্বার
সদস্য
পাবনা প্রেস ক্লাব,পাবনা