॥ আবদুল জব্বার ॥
৭১‘এর ২৫ মার্চ কালো রাতে দেশব্যাপী গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি শত্রুসেনারা। এদিন রাতে তারা রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়াটারে আক্রমণ করেছিল। এসময় একজন পুলিশ কনস্টেবল তার বার্তার মাধ্যমে এই সংবাদটি দেশের সকল পুলিশ বাহিনীকে জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনকারী পুলিশ বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার অনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে সম্প্রতি এ বাহিনী সম্পর্কে জনমনে নানা রকম প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পুলিশের কাজ দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং জনগণের সেবা করা। অথচ সেবা দানের বদলে এ বাহিনীর কতিপয় স্বার্থান্বেষী পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে বর্তমান সরকারও বিব্রত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে জনবান্ধব পুলিশ গঠনে পুলিশ বাহিনীকে অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করতে হবে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি গত ১৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ৩৬তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন।
১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাবনার ঐতিহাসিক মালিগাছা রণাঙ্গনে পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের সাথে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেছিলেন পাবনার আটঘরিয়া থানার এএসআই আবদুল জলিল। আমি শত শত মুক্তিকামী জনতার সাথে এ দিনের পুলিশ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু লিখব বলে কলম ধরছি।
ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার দেওভাগ গ্রামে তার বাড়ী। তিনি ওই সময় ঈশ্বরদীতে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। তার ছিল একটি সাইকেল। থানা থেকে বাসায় যাবার সময় সাইকেলটি পাবনা সদরের উপশহর বলে পরিচিত টেবুনিয়ায় রেখে বাসে চড়ে ঈশ্বরদীতে যেতেন। এরপর ঈশ্বরদী থেকে থানায় যাবার সময় টেবুনিয়া থেকে কাঁচা মাটির রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে আটঘরিয়ার থানায় যেতেন। এটাই ছিল তার কর্মস্থলে যাবার রুটিং পথ। শুধু ব্যতিক্রম হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সকাল ৭টায়। তিনি প্রতিদিনের ন্যায় ঈশ্বরদী বাসা থেকে বের হয়ে বাসযোগে টেবুনিয়ায় আসেন। তিনি জানতে পারেন পাকিস্তানি শত্রু সেনারা জোতকলসা গ্রামের গহের মন্ডল নামক একজন মুক্তিকামী যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে। এরপর ৬ জন শত্রুসেনা বৃষ্টির মতো গুলি করতে করতে পাবনা ঈশ্বরদী মহাসড়কের মজিদপুর গ্রামের বামপাশ দিয়ে পাবনার শহরের দিকে এগুচ্ছে। এ সময় এএসআই আবদুল জলিল সাইকেল চালিয়ে থানায় যাবার পথে দেবোত্তর বাজারে এসে সমবেত জনতাকে বলে ছিলেন মালিগাছায় শত্রুসেনারা গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। আপনারা দাঁড়ান আমি থানায় গিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসছি। এ সময় তিনি বলেছিলেন, যদি ওসি নিষেধ করে তবুও আমি আসবো। সাধারণ মানুষের সাথে ছিল আবদুল জলিলের ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিছুক্ষণ পর থ্রীনট থ্রী রাইফেল কাঁধে নিয়ে সত্যিই তিনি আসলেন সাইকেল চালিয়ে। এরপর সমবেত প্রায় অর্ধ শতাধিক মুক্তিকামী মানুষকে সাথে নিয়ে টেবুনিয়া হয়ে মালিগাছা বাজারের নিকট এসে পৌঁছালেন। বৃষ্টির মতো গোলাগুলি হচ্ছিল ঐ সময়। শত্রুসেনারা মজিদপুর গ্রাম হয়ে পাবনা-ঈশ্বরদী সড়কের বাম পাশ দিয়ে যাবার সময় সামনে পাবনা শহরের দিক থেকে গুলির শব্দ শুনে আর সামনের দিকে এগুতে সাহস পাননি। তারা মালিগাছা মোল্লাপাড়া (লেখকের বাড়ী)-এর পশ্চিম দিকে কেফাত মোল্লার বাড়ীতে গিয়ে একটি রান্না ঘরের মধ্যে ব্যাংকার করে ৪ জন আশ্রয় নিয়েছিল। অবশিষ্ট ২ জন শত্রুসেনা বাড়ীর মধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাননি। ততক্ষণে থ্রী নট থ্রী নিয়ে মজিদপুর গ্রাম থেকে কাজী আবু নঈম মালিগাছা বাজারে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আমার মামাতো ভাই আবদুর রশীদসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক মুক্তিকামী জনতা আগে থেকেই এখানে অবস্থান করছিলাম। এসময় চারদিক থেকে সেøাগান হচ্ছিল জয় বাংলা। আমরা সড়কের ডান পাশ দিয়ে এসে পৌঁছালাম মোকছেদ প্রাং-এর বাড়ীর সামনে ঠিক কেফাত মোল্লার বাড়ীর বিপরীতে। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ চারদিক থেকে হাতের কাছে যা পেয়েছিল তাই নিয়েই এ দিনের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল রকম সহযোগীতা করেছিল। এ সময় তারা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে রণাঙ্গণ প্রাঙ্গণে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়ে মনোবল শক্ত করেছিলেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ২ জন পাকিস্তানি শত্রুসেনাকে গুলি করে খতম করার পর নিজে গুলিবিদ্ধ হয়ে বীরের মতো শাহাদত বরণ করেছিলেন পুলিশের এ এস আই আবদুল জলিল। আমি এবং আমার মামাতো ভাই আবদুর রশিদ দু’জনই তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। আমি ছিলাম পাবনা শহরের আর এম একাডেমীর দশম শ্রেণির ছাত্র রশিদ ছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমি আর এম একাডেমী শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং রশিদ সদস্য।
এ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি শত্রুসেনার গুলিতে মুক্তিকামী ২ জন যুবক এবং আকমল হোসেন নামক একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন। আমরা ৭১‘এর ২৯ মার্চ ন্যাপ- ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলাম। আটঘরিয়া উপজেলার দেবোত্তর মসজিদের পাশে শহীদ আবদুল জলিলের বাঁধানো কবর রয়েছে। কবরের পাশে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কমপ্লেক্সটি উদ্ভোধন করেছেন। পাবনা পুলিশ লাইনের শহীদ মিনারে শহীদ আবদুল জলিলের নাম লিপিবদ্ধ করা আছে। রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়াটারের শহীদ মিনারে ৫নং শহীদের তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ করা আছে। বিগত ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের এদিনের ঐতিহাসিক স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য “মালিগাছা ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ” গঠন করা হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা এবাদত আলী সভাপতি এবং আমি সাধারণ সম্পাদক। এ দিন আরেকটি সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল পাবনা সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের ঐতিহাসিক মাধপুর বটতলায়। আর এই ২ রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম পাবনা জেলা শত্রু মুক্ত হয়েছিল। আজ যে রণাঙ্গনের যুদ্ধের বীরত্তের কাহিনী নিয়ে লিখলাম সেটা ইতোপূর্বে রণাঙ্গন মালিগাছা, ‘ইতিহাসের পাতা থেকে’ আমার লেখা নির্বাচিত কলাম, ২০১০ সালের ঢাকাস্থ পাবনা সমিতির ম্যাগাজিন ‘যে আগুন জেলেছিলাম’-এর ৭৭ পাতায় ‘একাত্তরে মালিগাছা রণাঙ্গনের রক্তঝরা একটি দিন’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
বিগত ২০১৩-১৪ সালে ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে জাতায়াত শিবির যখন হরতালের নামে পুলিশ বাহিনীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করছিল। ওই সময়ে আমি ৭১’এর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার একজন সহযোদ্ধা হিসেবে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। যার শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পুলিশ জামায়াত শিবিরের হামলায় প্রাণ দিচ্ছে ও লজ্জা রাখবো কোথায়।’ লেখাটি জাতীয় দৈনিক অনলাইন পত্রিকাসহ স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
পুলিশের পাবনা থানার ওসি ওবাইদুল হক দেড় বছর আগে পাবনা থানায় যোগদানের পর শুরু থেকেই বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, মানবাধিকার কর্মী, রাজনীতিবিদসহ সুশীল সমাজের মানুষের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন, বাদ পড়েনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। তার প্রিয়ভাজন ছিল, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী এবং সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। অপরাধী চক্রের পৃষ্ঠ পোষক হয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। সম্প্রতি পাবনায় গণধর্ষনের গঠনায় অভিযোগকারী নির্যাতিত গৃহবধুর সাথে থানা চত্ত্বতে ধর্ষকের বিয়েদিয়ে সমস্যায় পড়ে যান পাবনা থানার ওসি ওবায়দুল হক। গত ৭ নভেম্বর পাবনার স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ধারা বাহিক ভাবে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পাবনা জেলা পুলিশ প্রশাসন নির্দেশে প্রথমে থানা থেকে ওসিকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় এবং এস আই ইকরামুল হক কে বরখাস্ত করা হয়। ইতি মধ্যে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের তদন্ত টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। পুলিশের সদর দপ্তর থেকে পাবনা থানার ওসি ওবাইদুল হককে সাময়িকভাবে বরখাস্থ করা হয়েছে।
বর্তমান পাবনা পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম পিপিএম। তিনি গোপালগঞ্জের মানুষ। তিনি একজন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ইবনে মিজান ও একজন দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। যাদের কাছ থেকে আমরা সব সময় সহযোগিতা পেয়ে থাকি। সাম্প্রতিক সময়ে ওসি ওবাইদুল হকের অনৈতিক কর্মকা- এতই প্রশারিত হয়েছিল যে, আমরা তার অপকর্মের কথা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকটে জানাতে লজ্জাবোধ করতাম। গত বছরের ১৩ অক্টোবর রাতে রিপোটার্স ইউনিটির সভাপতি দৈনিক সংবাদের পাবনাস্থ স্টাফ রিপোটার হাবিবুর রহমান স্বপনকে হত্যা প্রচেষ্টায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী শফিকুল ইসলাম শফিকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করেননি পাবনা থানা পুলিশ। আমরা সাংবাদিক সমাজ আশা পোষণ করি, পাবনা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক হাবিবুর রহমান স্বপন হত্যা প্রচেষ্টার সাথে জড়িত শফিসহ সকল অপরাধী চক্র সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে পুলিশের গৌরবোজ্জল ভূমিকা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকার কর্মী
ই-মেইল :zabbar.pabna@gmail.com
আবদুল জব্বার