পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বই বাতিলের আন্দোলন

১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাস। ৯ম শ্রেনীর ছাত্রদের জন্য পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি নামে একটি বই বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হলো। বইটি রাজনৈতিক এবং বিতর্কিত লেখা ছিল । সেই বইটি বাতিলের দাবীতে দেশব্যাপী স্কুলের ছাত্ররা ব্যাপক আন্দোলন করেছিল। তীব্র আন্দোলনে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার সেই বইটি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল।

পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬২ এর হামিদূর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং ৬৯ এর গনআন্দোলনের পর ৭০ এর পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বই বাতিলের আন্দোলন ছিল সবচাইতে বড় আন্দোলন। এরমধ্যে উল্লেখ্য যে, ৭০ এর এই আন্দোলন ছিল স্কুল ছাত্রদের অংশগ্রহনে সংগঠিত আন্দোলন। তবে কালের পরিক্রমায় স্কুল ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনটি ৬৯ এর গনআন্দোলন আর ৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনের মাঝে চাপা পড়ে গেছে।

আমি তখন পাবনার ঐতিহ্যবাহী আর, এম,একাডেমীর ছাত্র। ছাত্রলীগের স্কুল কমিটির সভাপতি। ৬৯ এর গনআন্দোলনে গঠিত বৃহত্তর পাবনা জেলা স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক। উক্ত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ( মেনন) ও ছাত্র ইউনিয়ন ( মতিয়া) সমন্বয়ে গঠিত। আহবায়ক জুবলি স্কুলের আনোয়ার, যুগ্ম আহবায়ক তাহের, আব্দুল জব্বার, রশিদ, কাশেম এবং আমি।

জানুয়ারী থেকেই বইটি নিয়ে আলোচনা সমলোচনা শুরু হলো। বইটি আমাদের হাতে পাবার আগেই স্যারদের মধ্যে ক্ষোভ শুরু হলো। মনে পড়ে আমাদের স্কুলের নিরঞ্জন স্যার সহ কয়েকজন শিক্ষক ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে বইটি দেখিয়ে বলেছিল এই বই বিতর্কিত। এই বই আমরা পড়াতে চাইনা। আশাকরি তোমরাও এটা পড়বে না। গোটা বইটিতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কৃষ্টিকে গুরুত্ব দিয়ে বাঙালী কৃষ্টিকে অবমাননা করা হয়েছে। বইটির প্রথমেই পাকিস্তানের মানচিত্র, জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ সহ পাকিস্তানী নেতাদের কর্মকান্ড ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে।বইটি নামের সাথে যথার্থ হলেও বাঙালীর জন্য তা শিক্ষামূলক নয়।

আমরা স্যারদের অনুপ্রেরণায় দ্রুত পূর্বে গঠিত স্কুল সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করলাম। সিদ্ধান্ত হলো বইটি বাতিলের জন্য আন্দোলন করবো। স্কুলে স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের মাঝে প্রচারনা চালাবো। তাদের সংগঠিত করবো। মিটিং মিছিল করবো। প্রয়োজনে ক্লাশ বর্জন করবো। আমরা পাবনাতে অল্প সময়ের মধ্য আন্দোলন তীব্রভাবে গড়ে তুললাম। তখন জেলাস্কুল বাদে সব স্কুল ক্লাশ বর্জন করে ধর্মঘটে সামিল হয়েছে। এরমধ্যে চারদিক থেকে খবর আসতে থাকলো এ আন্দোলন দেশব্যাপী শুরু হয়েছে। আমরা সম্মিলিতভাবে জেলার ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করলাম। প্রেসক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদের সাথে বৈঠক করলাম। তখনতো যোগাযোগের বেহাল অবস্থা। আজকের ঘটনা কয়েকদিন পর জানা যেত। সংবাদ আদান প্রদানের মাধ্যম হলো সংবাদ পত্র। সেটারও ছিল করুন হাল। আজকের জরুরী খবর ডাকযোগে ৩/৪ ধরে যেত আর সেটা ছাপা হলে তা পাঠকের কাছে আসতো ৩/৪ দিন পর। একসময় উত্তরাঞ্চলে পাবনার পাঠকেরা ছিল ভাগ্যবান। ঈশ্বরদী পর্যন্ত প্লেনে পেপার আসায় ঐদিনই পড়া যেত। তা নাহলে ট্রেনে এলে আজকের পেপার কাল বা কোন কোন জেলায় ২/৩ দিন পর পাওয়া যেত। তবে পাঠক যেদিন পেতো সেদিনই মনে করতো নতুন পেপার। যাইহোক প্রসঙ্গ হলো এতবড় ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ পেপারওয়ালাদের কাছে তেমন গুরুত্ব ছিলো না। তবে তীব্র আন্দোলন চলতে থাকলে সবাই গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে।

আন্দোলন চলাকালে প্রতিদিন বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে মিটিং, শহরে মিছিল এবং সমাবেশ করা হতো। আমরা দলবদ্ধভাবে পাবনার স্কুলগুলি শেষ করে ঈশ্বরদী, উল্লাপাড়া ও সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলাম। ঐ সময়ে পাবনা টাউন হল ময়দানে বৃহৎ ছাত্র সমাবেশ করে বইটি আগুন দিয়ে পুড়ানো হয়েছিল। বইটি পুড়ানোর পর পুলিশ ও গোয়েন্দারা আমাদের গ্রেপ্তার করার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল। তাদের অভিযোগ ছিল আমরা বইটিতে আগুন দিয়ে জাতীয় পতাকা ও জাতির পিতার ছবি পুড়িয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করেছি।

প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য, উক্ত আন্দোলনে সার্বক্ষণিক জড়িত থাকার সাথে আমার ব্যক্তিগত একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। সেই আন্দোলনের উপর আমার রচিত আট পৃষ্টার একটি কবিতা। সেই সময় যা খুবই আলোচিত হয়েছিল। চার আনা মূল্যের সেই কবিতা পুঁথিপাঠের সুরে হাটে বাজারে, স্কুল কলেজে বিক্রি হয়েছে। সেই আলোচিত কবিতাটি লেখা ও প্রচারে বন্ধুবর কুদ্দুস ( কবি আঃ কুদ্দুস পদ্মা) আর ওমর আলীর ( মক্তব পাড়ার প্রয়াত আধ্যাত্মিক গুরু) বিরাট ভুমিকা ছিল। কবিতাটি শহরে পাঁচমাথা মোড়ে অবস্থিত প্যারাডাইস প্রেসে মুদ্রিত হয়েছিল। ঐ প্রেসের কম্পজিটার ছিল আব্দুল হামিদ খান ( নাজিরপুরের প্রয়াত সাংবাদিক)। সেই কবিতার কিছু অংশ স্মৃতির ভান্ডার থেকে আপনাদের সমীপে নিবেদন করছি।

বলি ভাইরে ভাই ( ২) বলে যাই, আজব ঘটনা – ছাত্র ছাত্রীদের কথা করিবো বর্ননা। শোনেন মন দিয়া ( ২) কি বলিয়া, করিবো বর্নন – ভাবিয়া আকুল আমি আকুল হিয়া মন। বলতে হৃদয় ফাটে ( ২) মাঠে মাঠে, কৃষক মজুর জন – কলে কলে শ্রমিক ভাইয়েরা স্কুলের ভাই বোন। নামলো রাজপথে ( ২) মেঠো পথে, অলিতে গলিতে – ভাঙ্গিয়া পড়িল তারা সারিতে সারিতে। ঘরে ঘরনী গন ( ২) করে গর্জন, বলে রাজার তরে – একি প্রবঞ্চনা তুমি আনলে ঘরে ঘরে। পেয়েছি স্বাধীনতা ( ২) ইংরেজ কুত্তা, তারই বাংলা হতে – চেয়েছিনু পরনের কাপড় দু’মুঠো ভাত খেতে। আরো লেখাপড়া ( ২) মজুর ভাড়া, সুখেরও সংসার – দাওনি তাহা তুমি মোদেরে চুষেছো রক্ত হাড়। গত তেইশ বছরে ( ২) দেশের তরে, দাওনি শিক্ষা কানুন – উপরন্ত বারে বারে কত আইন কানুন। দিয়েছো মোদের পরে ( ২) ঘাড়ে ঘাড়ে, বইয়ের বোঝার আঁটি – পড়তে গিয়ে দেখি ভাইরে সব হয়েছে মাটি। বরং এর চাইতে ( ২) ক্ষেতে ক্ষেতে, কাজই ছিল ভাল – এই রুপেতে বঞ্চিত ভাই হতে শিক্ষার আলো।

যাইহোক আন্দোলন প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, দেশব্যাপী স্কুল ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে এক পর্যায়ে সরকার বিতর্কিত ” পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি ” বইটি বাতিল করতে বাধ্য হয়। আজ থেকে ৪৭ বছর আগের এমন একটি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস তুলে ধরতে যেয়ে বলতে হচ্ছে – ৭০ এর পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি আন্দোলনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংগ্রামী ছাত্ররাই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সৈনিক হয়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যে পাকিস্তানী চাঁদ তারা পতাকাকে নামিয়ে এই ভূখন্ডে প্রতিষ্ঠিত করলো – লাল সবুজের বাংলাদেশ।

( সমাপ্ত)

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।