বাঙালী জাতির শত বছরের শ্রেষ্ঠ গৌরব ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন। এই উপমহাদেশে গত হাজার বছর বাঙালী জাতির উপর বার বার আঘাত এসেছে। দেশী বিদেশী সাম্রাজ্য শক্তি নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য এই জাতিকে খন্ড বিখন্ড করেছে। এরমধ্য গত শতকের ঘটনাটি বেশী উল্লেখযোগ্য। দুই শত বছর বৃটিশ শাসনের সমাপ্তিতে এলো বড় আঘাত। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রদান কালে ইংরেজরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করে এক ভারতবর্ষকে দুই রাষ্ট্র বানানো হলো। সবচাইতে অদুরদর্শী সিদ্ধান্তটি হলো হাজার মাইলের ব্যবধানে দুই খন্ড ভূমি নিয়ে পাকিস্তান বানানো। সেদিন যদি অখন্ড ভারতবর্ষ হতো অথবা জাতীয় স্বকিয়তায় বাঙালীদের জন্য পৃথক দেশ হতো তাহলে এই ভূখন্ডের ইতিহাস হতো আরেক রকম।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় এই অঞ্চলের কোন মানুষের দাবী ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তান বানানো ছিল বাঙালীর জাতীর উপর সবচাইতে বড় আঘাত। ভারতের বিহার প্রদেশ সহ মুর্শিদাবাদ, মালদা জেলা সহ বহু এলাকা এমনকি কয়েকগুন বেশী মুসলমানকে ভারতে রেখে পাকিস্তানকে মুসলিম রাষ্ট্র বানানো হলো। এমনকি এখনো পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেশী মুসলমান বাস করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরই বাঙালী জাতীর উপর প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। এক বছরের মধ্যেই শাসকরা ঘোষনা করলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। হাজার বছরের বাংলা এখন বাদ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠান,বেলুচ, সিন্ধুর লোকেরা এসে ইংরেজদের স্থলাভিষক্ত হলেন। পাশের বিহার প্রদেশ থেকে হাজার হাজার বিহারী আমদানী করে খুলনার খালিশপুর, ঈশ্বরদী, শান্তাহার, পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, ঢাকার মিরপুর এবং মোহাম্মদপুর প্রভৃৃতি এলাকায় জমি দিয়ে দালান বানিয়ে দিয়ে বসতি স্থাপন করে দিলেন । রেল বিভাগ, পুলিশ সহ বিভিন্ন দপ্তরে চাকুরী দিয়ে পুর্ব পাকিস্তানকে নয়া পাকিস্তান বানানো এবং বাঙালীদের সংখ্যালঘু এবং দুর্বল জাতি বানানোর চক্রান্ত শুরু করলো।
১৯৪৮ সালেও এই অঞ্চলে বাঙালীর অধিকার আদায়ের জন্য কোন দল ছিলো না । ঐ বছরে ৪ ঠা জানুয়ারী ছাত্রলীগ গঠন এবং ১৯৪৯ সালে মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর অধিকার আন্দোলন শুরু হলো। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত্য তীব্র আন্দোলন এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন অব্যাহত থাকলো। অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিক সহ বহু শহীদের রক্ত বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর জয় হলো। পাকিস্তানী শাসকরা নতি স্বীকার করলো এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হলো। বাঙালী অর্জন করলো মাতৃভাষা বাংলা।
পাকিস্তান শাসনের ২৪ বছরে পালাবদল। স্বাধীন হবার অল্পদিনের মধ্যেই শাসক লিয়াকত আলী খান খুন হলেন। তথাকথিত জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরন করলেন। সামরিক শাসক জেনারেল সাঈদ ইসকেন্দার, জেনারেল আইয়ুব খান, জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাজনীতিবীদদের বিতারিত করে ১৪ বছর দেশ শাসন করলেন। এরপর ১৯৬৯ সালে তীব্র গনআন্দোলনে মুখে আইয়ুব খানের ১০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। অন্তর্বতী সামরিক সরকার ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে ৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। সেই নির্বাচনে বাঙালী জাতির অবিসংবিদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বধীন আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তান শাসন করার ম্যান্ডেট পেলে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার এবং বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। নয়মাসের যুদ্ধে ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করেন, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানী করেন, ২ কোটি লোকের বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেন। তারপর ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত হন। বাঙালীরা অর্জন করেন স্বাধীনতা এবং ফিরে পান প্রিয় বাংলাদেশ।
এই লেখা এতটুকু লিখলে আর কোন প্রশ্ন থাকেনা। অথচ শিশু মনের মত বার বার বিবেককে দংশন করছে। মনটা বার বার বিবেকের কাছে প্রশ্ন করছে – ৫২ এর ভাষা আন্দোলন আর ৭১ এর স্বাধীনতার সফলতা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি। বিবেক বলছে আমরা কাঙ্খিত সফলতা এখনো অর্জন করতে পারিনি। বাহ্যিক বলার মত অনেক তবে ভিতরে অন্তসারশুণ্য। মহান শহীদ দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে গেছে। মানুষের অন্তরে আমরা কতটুকু ছড়াতে পেরেছি? আমরা কি রাষ্ট্রীয় ভাবে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি? ৫২ এর একুশ ছিল অগ্নিঝরা দিন – শোকের মহিমায় মহিম্বিত। বাঙালী চেতনায় উজ্জিবিত। সে চেতনা আজ বিলুপ্তপ্রায়। বিদ্যমান একুশ মানে বইমেলা, গান বাজনা, আনন্দ আর উৎসব। শোকের আবহ নাই, কালো কাপড়ের বদলে রঙ্গিন কাপড় স্থান পেয়েছে। এখন প্রভাতফেরী হয় মধ্যরাতে। সালাম, বরকত, রফিক জব্বারদের ভুলতে বসেছি। একুশের বাংলা এখন বাংলিশ হয়েছে। কি দুর্ভাগা আমাদের ভাষা!! প্রয়োজনে – অপ্রয়োজনে নিজের ভাষায় কথা না বলে আমরা অন্য ভাষায় কথা বলি। অথচ পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ, শিক্ষিত মানুষ তারা ভূল করেও অন্য ভাষায় কথা বলতে চায়না।
৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত আমার প্রিয় দেশের কথা যদি বলি, তাহলে কয়জন বলবেন এদেশে ভাল আছি? আমার ধারনা সবাই বলবেন ভাল নাই। অভাব নাই তারপরেও বলতে হয় ভাল নাই। কারন ঘুষ দুর্নীতি আমাদের দেশের কাঙ্খিত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করছে। সকল ক্ষেত্রে সুশাসনের বড় অভাব। আমরা যতক্ষন পর্যন্ত্য দুর্নীতিকে নির্মুল করতে না পারবো তত্ক্ষন পর্যন্ত্য কাঙ্খিত বিজয় অর্জিত হবে না। পরিশেষে বলতে চাই আমাদের দেশে আরেকটি লড়াই দরকার যে লড়াই হবে সমাজ পরিবর্তনের লড়াই।
( সমাপ্ত)
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর, পাবনা।