প্রজাপতির রঙ্গিন জীবনিকথা।

আমাদের চারপাশে তো কত প্রাণীই রয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে সব প্রাণীই কি দেখতে সমান সুন্দর? এমন অনেক প্রাণীই রয়েছে আমাদের আশেপাশে, যেগুলোকে দেখতে রীতিমতো ভয়ংকর। এর বিপরীতে আবার এমন অনেক প্রাণীই রয়েছে, যেগুলোকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। এমনই সুন্দর দেখতে প্রাণীদের মধ্যে সবার ওপরের দিকেই থাকবে যেটি, তার নাম প্রজাপতি। রঙ-বেরঙের কত রকম যে প্রজাপতি রয়েছে, তার ইয়াত্তা নেই। নানা রঙে রঙিন ডানাঅলা প্রজাপতিরা যেন সৌন্দর্যের প্রতীক।
সত্যিই তো, প্রজাপতির মতো এমন সুন্দর দেখতে আর কোন প্রাণী রয়েছে! পৃথিবীতে এর বিচরণও কম দিনের নয়। বিজ্ঞানীরা প্রজাপতির যেসব পুরোনো ফসিল পেয়েছেন, সেগুলোর কোনো কোনোটির বয়স চার থেকে পাঁচ কোটি বছর! তার মানে বুঝতেই পারছ, পৃথিবীর ইতিহাসের এক আদ্যিকালের সাক্ষী এই প্রজাপতি।
প্রাণীজগতে প্রজাপতি
প্রাণিজগতে আর্থ্রোপোডা পর্বের পতঙ্গ শ্রেণির মধ্যে পড়ে প্রজাপতি। এখন পর্যন্ত বিশ হাজারের মতো প্রজাতি পাওয়া গেছে প্রজাপতির। আর এই সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। লেপিডোপেট্রা বর্গের এই পতঙ্গের দেখা মেলে অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর বাকি সব অঞ্চলেই। এই বর্গের সাতটি পরিবার রয়েছে এবং প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি।
নানা রকম প্রজাপতি
প্রজাপতির ডানার আকার-আকৃতি, রঙ ও নকশায় রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। নানা ধরনের প্রজাতি থাকার কারণেই এমনটি হয়েছে। এর মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট যে প্রজাপতির সন্ধান পাওয়া যায়, তার নাম ‘ওয়েস্টার্ন পিগমি ব্লু’। ডানা মেলা অবস্থায় এর আকার এক ইঞ্চির অর্ধেক। অন্যদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজাপতির নাম হলো ‘কুইন আলেক্সান্দ্রিয়াস বার্ডউইং’। ডানা মেললে এরা লম্বায় প্রায় ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের মধ্যে অবশ্য ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা একটু বেশি লম্বা হয়।
প্রজাপতির বাসস্থান
আগেই বলা হয়েছে, এন্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর সব অঞ্চলেই প্রজাপতির দেখা মেলে। আর এদের বাসস্থান বলতে আলাদা করে কিছু নেই। অর্থাত্ এরা ঠিক বাসা তৈরি করে বাস করে না। যেকোনো ধরনের গাছের ডাল, ঝোপঝাড়, ইটের খাঁজ, বিল্ডিংয়ের মাঝের ফাঁকা জায়গাগুলোই প্রজাপতির আবাস।
প্রজাপতির খাবার
অনেক পতঙ্গের মতোই প্রজাপতির মূল খাবার হলো ফুলের মধু। তবে ফুলের রেণু, গাছ থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন ধরনের রস, পাকা ফলের রস, পঁচা মাংস, মাটি ও বালুতে দ্রবণীয় তরল আকারে খনিজ পদার্থ প্রভৃতিও খাবার হিসেবে গ্রহণ করে প্রজাপতি। এসব খাবার থেকে চিনি বা গ্লুকোজ এবং বিভিন্ন ধরনের খনিজই প্রজাপতিকে বেঁচে থাকার শক্তি দেয়। মানুষের শরীরেও কখনও কখনও বসে প্রজাপতি। শরীর থেকে যে ঘাম বের হয়, তার লবণ খেয়ে নেয়াই থাকে প্রজাপতির মূল উদ্দেশ্য। কিছু কিছু প্রজাপতি অবশ্য নানা ধরনের ছোট ছোট পতঙ্গও খেয়ে থাকে।
প্রজাপতির জীবনচক্র
প্রজাতিভেদে প্রজাপতিরা এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে এক বছরও বাঁচতে পারে। তবে সাধারণত প্রজাপতির জীবনকাল হয়ে থাকে এক মাসের মতো। প্রজাপতির জীবনচক্রের চারটি ধাপ রয়েছে। এগুলো হলো— ডিম, লার্ভা, পিউপা এবং পরিণত প্রজাপতি।
ডিম :স্ত্রী প্রজাপতি সাধারণত পাতার ওপর ডিম পাড়ে। এই ডিমগুলোর চারপাশে কোরিওন নামের এক ধরনের শক্ত আবরণ থাকে। আর ডিমগুলো যাতে পাতা থেকে না পড়ে যায় তার জন্য এক ধরনের আঠালো পদার্থ দিয়ে আটকানো থাকে পাতার সাথে। কোনো কোনো প্রজাপতি কেবল নির্দিষ্ট কোনো গাছের পাতাতেই ডিম পাড়ে। আবার কোনো কোনো প্রজাপতি ডিম পাড়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট গাছকে বেছে নেয়। ডিম অবস্থায় বেশ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় অতিবাহিত হয়। শীতের আগে আগে ডিম পাড়া হলে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রাখা হয় এবং শীত শেষ হলে বসন্তে ডিম ফোটে বাচ্চা বের হয়। অনেক প্রজাপতি আবার বসন্তে ডিম পাড়ে এবং সেগুলোর বাচ্চা ফোটে গ্রীষ্মে।
লার্ভা :প্রজাপতির ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। এগুলোকে ইংরেজিতে ক্যাটারপিলার, বাংলায় বিছা বা শুঁয়োপোকাও বলা হয়ে থাকে। এরা খুব দ্রুত বড় হয় এবং এদের বড় হওয়ার জন্য প্রচুর খাবার দরকার হয়। সাধারণত গাছের পাতা খেয়ে থাকে এরা। দুয়েকটি প্রজাপতি অবশ্য পতঙ্গও খেয়ে থাকে। লার্ভা থেকে পিউপা হওয়ার জন্য কয়েকদিন সময় লাগে। এই সময়ের শেষ ভাগেই ডানা তৈরি হয়।
পিউপা :লার্ভা বা ক্যাটারপিলার অবস্থার শেষ সময়ে বিশেষ এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয় এবং লার্ভাগুলো পিউপায় পরিণত হওয়ার জন্য সাধারণত নিজেদের আকারের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের পাতার নিচের দিকে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসময় এদের শরীরের চারপাশে নতুন এক ধরনের খোলস তৈরি হয় এবং এগুলো সাধারণতই নিশ্চল অবস্থায় পাতার সাথে এঁটে থাকে। পিউপা অবস্থাতেই পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতির গঠন সম্পূর্ণ হয়।
প্রজাপতি :পিউপা অবস্থায় সপ্তাহ দুয়েক সময় কাটানোর পর বাইরের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে রঙিন প্রজাপতি। তবে শুরুতেই প্রজাপতি উড়তে পারে না। এদের ডানাগুলো ভেজা অবস্থায় থাকে। বেশিরভাগ প্রজাপতির ডানা শুকিয়ে নিতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। অনেকের ক্ষেত্রে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত সময়ও লাগতে পারে। ডানা শুকালে তবেই উড়ে বেড়ানো শুরু করে প্রজাপতি।
প্রজাপতির ডানা
প্রজাপতির ডানা দেখতে যেমন রঙিন, তেমনি এর গঠনও বিস্ময়কর। প্রজাপতির ডানার উপরিভাগে মূলত এক ধরনের আঁশের স্তর থাকে। এই আঁশের স্তরগুলোতে থাকে মেলানিন নামের রঞ্জক পদার্থ যা এগুলোকে কালো ও বাদামী রঙ দেয়। তবে প্রজাপতির ডানায় লাল, নীল, হলুদ এবং আরও উজ্জ্বল যেসব রঙ দেখা যায় সেগুলো এই আঁশের গঠনিক বৈশিষ্ট্যের ফলাফল। এই স্তরটি মূলত স্বচ্ছ। তবে এর ওপর আলো পড়লে বিচ্ছুরিত হয়ে ডানাকে রঙিন করে তোলে।
প্রজাপতির আরও কথা
বেশিরভাগ প্রজাপতি দিনের বেলায় সক্রিয় থাকে এবং রাতে বিশ্রাম নেয়। এরা একা একা বা দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। ফুলে ফুলে উড়ে মধু খাওয়ার সময় পরাগায়ন ঘটিয়ে থাকে প্রজাপতি। মাইগ্রেটরি ধরনের কিছু প্রজাপতি রয়েছে যেগুলো চার থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণ করে থাকে। প্রজাপতি শুনতে পায় না। তবে এরা কম্পন অনুভব করতে পারে। এরা পায়ের সাহায্যে স্বাদ গ্রহণ করে থাকে। আর এদের অ্যান্টেনা বা শুঁড়ের সাহায্যে গন্ধ পায়। এদের রঙিন ডানার মাধ্যমে এরা অন্যদের আকৃষ্ট করে। শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যও রঙিন ডানা সহায়তা করে প্রজাপতিকে।
আমাদের দেশেও অবিবাহিত কারও গায়ে প্রজাপতি বসলে তার বিয়ের সময় হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া প্রজাপতিকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।