ইয়ানূর রহমান : যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল বহিরাগতদের দখলে চলে গেছে। এখানে কর্মচারী সংকটের অজুহাতে একের পর এক বহিরাগতদের নিয়োগ দেয়ায় এ অবস্থার বিরাজ করছে। রোগীদের সেবা নিশ্চিত করার মানসিকতায় কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়োগ প্রদান করলেও বর্তমানে হচ্ছে তার উল্টোটা।
তারা হাসপাতালের পরিচয়পত্রকে পুঁজি করে প্রতারণা ও অর্থবাণিজ্যে লিপ্ত। মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করা হলো তাদের মূল টার্গেট। এসব স্পেশাল কর্মচারিদের দাপটের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা লোকজন রীতিমতো অসহায়।
হাসপাতালের প্রধান করণিক আসগর আলী জানান, সরকারি এ হাসপাতালে রাজস্ব খাতে কর্মচারী রয়েছে ১শ’ ২ জন ও উন্নয়ন খাতে কর্মরত রয়েছেন ৭৪ জন। এছাড়া আউট সোসিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী রয়েছেন ১৭ জন। হাসপাতালের নিজস্ব কর্মচারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ২৫০ শয্যার হাসপাতালে মোট কর্মচারীর সংখ্যা রয়েছে ১শ’ ৯৩ জন। হাসপাতালের মোট ৯টি ওয়ার্ড ও বর্হিবিভাগের জন্য কি এই কর্মচারী যথেষ্ট না। তাহলে কি কারণে কর্মচারী সংকট দেখিয়ে সরকারি এ হাসপাতাল বহিরাগতদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। বিষয়টিকে তারা মোটেও ভালো চোখে দেখছেন না।
সূত্র জানায়, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. কামরুল ইসলাম বেনু ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ৪২ জনকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বিনা বেতনে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ প্রদান করেন। আর বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু ২০১৯ সালের জুন ও জুলাই মাসে মোট ৩০ জনকে জনগোষ্ঠি সহায়তায় নিয়োগ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ি নিয়োগ প্রক্রিয়া হলো দুই ধরণের। একটি হল সরাসরি নিয়োগ ও অপরটি হলো ঠিকাদারের মাধ্যমে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে কর্মচারি নিয়োগ দেয়া। সে অনুযায়ী যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে মোট ৭২ জন বহিরাগতকে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রক্রিয়া মানা হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে নিয়োগবোর্ড গঠন করে তাদের নিয়োগ প্রদান করেন। তবে সৎ উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়োগ প্রদান করেছিলেন। স্বেচ্ছাসেবী ৪২ জন হাসপাতাল থেকে কোনো টাকা না পেলেও জনগোষ্ঠীর সহায়তায় নিয়োগ পাওয়া ৩০ জন প্রতি মাসে বেতন পাচ্ছেন। তাদের হাতে বেতনের টাকা তুলে দেন বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ,অস্ত্রোপচার কক্ষ,পুরুষ ও মহিলা সার্জারী ওয়ার্ড,পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ড, পুরুষ ও মহিলা পেয়িং ওয়ার্ড, মডেল ওয়ার্ড, লেবার ওয়ার্ড, গাইনী ওয়ার্ড,সংক্রামক ওয়ার্ড এবং শিশু ওয়ার্ডে সরকারি কর্মচারিদের পাশাপাশি বহিরাগতরাও দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সরকারিভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারিরা একটু কৌশলে আর বহিরাগতরা প্রকাশ্যে অর্থবাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছেন। টাকা ছাড়া কোন কাজ করেননা তারা। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই অবৈধ বাণিজ্য চলে আসছে। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্য বেড়েছে কয়েকগুণে। তারা ২শ’ টাকার কম নিচ্ছেন না।
বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজন সালেহা খাতুন, আলেয়া বেগম, কাকলি বেগম, ইসমাইল হোসেন, আলী হোছেন, লাল মিয়া, সুলতান মীর, মগগুল হোসেনসহ আরো কয়েকজন জানান, ক্যাথেটার লাগাতে গেলে টাকা, খুলতে গেলে টাকা, টলি ঠেলতে গেলে টাকা, ড্রেসিং করতে গেলে টাকা, প্লাস্টার করতে গেলে টাকা, বিষ ওয়াশ করতেও রোগীর স্বজনদের কাছে টাকা দাবি করা হচ্ছে। এমনকি টাকা ছাড়া মিলছে না শয্যা। কে সরকারি কর্মচারী আর কে বহিরাগত কর্মচারী তা বোঝেন না। ওয়ার্ডে যে যখন দায়িত্বে থাকে সেই টাকা ছাড়া কোনো কাজ করেন না। অসহায় মুহুর্তে তারাও কর্মচারীদের টাকা দিতে বাঁধ্য হন। কেন না তাদের চাহিদামতো টাকা না দিলেই পরবর্তীতে আর কোনো কাজ করেন না তারা ।ডাকলেও রোগীর কাছে আসতে চায় না। এমনকি মারমুখি আচরণ করা হয়।
স্বজন পারুল বগম জানান, প্রসূতি ওয়ার্ড ও লেবার ওয়ার্ডে বকখিসের নামে ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকা দাবি করা হয়। ছেলে সন্তান হলে ১ হাজার ও মেয়ে সন্তান হলে ৫শ। দাবি করা টাকা না দিলে রোগীর স্বজনদের সাথে খারাপ আচরণ করেন ওয়ার্ডবয় ও আয়া। শারমিন আক্তার নামে একজন জানান, সম্প্রতি তার এক রোগীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রোগীর পিলাস্টার ও ক্ষতস্থান সেলাই করা বাবদ সাড়ে ৫শ টাকা নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে সরকারি এই হাসপাতাল বহিরাগতদের দখলে চলে গেছে। হাসপাতালের নিজস্ব কর্মচারীদের চেয়ে তারা আরো বেশি ব্যস্ত থাকেন অর্থ আয়ের ধান্দায়। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে অর্থ আয়ের ধান্দা করছেন সরকারি কর্মচারীরাও। তাদের রোষানলে রোগীর স্বজনরা রয়েছেন চরম বিপাকে।
বহিরাগতদের নিয়োগের ব্যাপারে বিগত দিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক ডা. রওশন আনোয়ার বলেছিলেন, সরকারের নির্দেশনার বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাউকে নিয়োগ দিলে সেটা হবে অবৈধ। সরকারি হাসপাতালে কোনো কর্মকর্তা নিজেদের ইচ্ছায় কারো নিয়োগ প্রদান করতে পারেন না।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু জানান, আগের ৪২জন বহিরাগতকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি তার জানা নেই। বর্তমানে রোগীর তুলনায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকট রয়েছে। যে কারণে জনগোষ্ঠির সহায়তায় তিনি ৩০ জনকে নিয়োগ প্রদান করেছেন। তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া আছে রোগী ও স্বজনদের জিম্মি করে অর্থবাণিজ্য না করতে। এরপরেও যদি কেউ বাণিজ্যে লিপ্ত থাকে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। #