যে স্মৃতি অমলিন –

। আমিরুল ইসলাম রাঙা। 
১৯৭২ সালের ১০ মে । স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুইদিনের জন্য পাবনা সফরে এলেন। যথারীতি নির্ধারিত সময়ে হেলিকপ্টার নিয়ে পাবনা ষ্টেডিয়ামে অবতরন করলেন। সফরসঙ্গী তাঁর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ। ষ্টেডিয়ামে হাজার হাজার জনতা। পুলিশ, মিলিটারী আর পাহারাদার চোখে পড়ছে না। হেলিকপ্টার অবতরনের পর বঙ্গবন্ধু দরজার সামনে দাড়িয়ে সকল মানুষকে হাত নেড়ে সালাম জানাচ্ছেন আর স্বভাবসূলভ সেই হাত নিজের মাথায় বুলিয়ে নিচ্ছেন। মনে হচ্ছে – বাঙালী জাতির প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নাই।

একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন। উনাকে অভ্যর্থনা জানালেন পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। পিছনে তোফায়েল আহমেদ এবং আমলাবৃন্দ। ষ্টেডিয়ামে হাজার হাজার জনতা সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু সবার সাথে হাত মিলাচ্ছেন। কেউ তাঁর ভালবাসা থেকে বাদ পড়ছে বলে মনে হচ্ছেনা। কোন কোন জায়গায় হাত মিলিয়েই শেষ হচ্ছেনা। কথা বলছেন আবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরছেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

আমার জীবনে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালে পাবনা টাউন হলে। তখন আমি ১৩/১৪ বছরের কিশোর। সেদিনের সেই মনোমুগ্ধকর ভাষনই আমাকে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে। ১৯৭০ সালে দেখেছিলাম দুইবার। একবার রাজনৈতিক সফরে পাবনা এলে বগা চাচার বাড়ীতে উনার সাক্ষাৎ পেয়ে ” পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি”এর বিরুদ্ধে আমার লেখা কবিতা শোনানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। পরের বার এসেছিলেন ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। পাবনায় নক্সালপন্থীদের হাতে নিহত নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য আহমেদ রফিক খুন হবার পর। স্বাধীনতার পর কাছে থেকে দেখেছিলাম ১৯৭২ সালে ২০ শে জানুয়ারী ঢাকা ষ্টেডিয়ামে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠানে। আর শেষবার পেলাম পাবনা ষ্টেডিয়ামে।

বঙ্গবন্ধুকে বরন করার জন্য নিজহাতে বানানো মালা নিয়ে দাড়িয়ে আছি। আমার সাথে আছে , পাবনা পলিটেকনিকের জি,এস আবদুল হাই তপন, আবুল কাশেম বিশ্বাস ( বর্তমানে পাবনা সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার), আল মাহমুদ নিটু ( বর্তমানে পাবনা জেলা জাসদের সহ সভাপতি) প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু আমার কাছে এলে উনাকে মাল্যদান করে ( ছবি সংযুক্ত) বললাম আমি রাঙা। পাবনা জেলা ছাত্রলীগের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইছামতি পত্রিকার সম্পাদক। পাবনা জেলা স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক। আমি আপনাকে পাকিস্থান দেশ কৃষ্টির বিরুদ্ধে লেখা কবিতা শুনিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমার কথা শেষ না হতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আশির্বাদ ও ভালবাসায় সিক্ত করলেন। এরপর প্রায় একঘন্টার বেশী সময় ধরে পাবনা ষ্টেডিয়ামে অবস্থানরত জনতার সাথে মিলেমিশে একাকার হলেন। পুলিশ বাহিনীর সালাম গ্রহন করলেন। পরিশেষে জহুরুল ইসলাম বিশু ভাইয়ের আম্মার ( বকুল ভাইয়ের খালা) নেতৃত্বে আওয়ামী মহিলা সেচ্ছাসেবক বাহিনীর গার্ড অব অনার গ্রহন করে ষ্টেডিয়াম ত্যাগ করলেন।

সন্ধ্যার পর বনমালীতে নাগরিক সংবর্ধনায় স্বহস্তে লিখিত মানপত্র দেবার সুযোগ পেলাম। প্রায় ৪৫ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষন এখনো কানে বাজে। পাবনার প্রতি তাঁর ভালবাসা, প্রবোল আবেগ এর কথা বর্ননা করেন। ( এই পাবনায় তাঁর একমাত্র ভাই শেখ নাসের এর শশুরবাড়ী।) বক্তব্যের শুরুতে পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি প্রয়াত আমজাদ হোসেন, শহীদ এডভোকেট আমিনুদ্দিন, আহমেদ রফিক এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানীদের নির্মমতা, গনহত্যা, মা বোনের উপর নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে বার বার অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ কেমন করে পূনর্গঠন করবেন। কেমন করে দেশের মানুষকে বাঁচাবেন – সেটা বলতে গিয়ে বিচলিত হয়ে পড়ছিলেন। বক্তব্যের শেষে পাবনাবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, রিক্ত আমি- নিঃস্ব আমি, দেবার কিছু নাই – আছে শুধু ভালবাসা দিয়ে গেলাম তাই।

আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর শাহাদতবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমিও বলতে চাই, রিক্ত আমি – নিঃস্ব আমি – দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালবাসা – তোমায় দিলাম তাই -।

—– সমাপ্ত —-

লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা 
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।