এক হাদিস শরিফে সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কারণ এই জাতি সব বিবাধ ভুলে গিয়ে দলমত-জাতিবর্ণ নির্বিশেষে মহান প্রভুর কুদরতি পায়ে মাথা অবনত করে সেজদায় ইবাদতে মগ্ন হয়।
প্রত্যেক ধর্মেরই কিছু নির্দ্দিষ্ট আচার-অনুষ্টান আছে যার দ্বারা সেই ধর্মের অনুসারিগণ এক স্থানে সমবেত হন। একে অন্যের সাথে সাক্ষাত হয়। কিন্তু পৃথিবীর সব ধর্মের চেয়ে ইসলাম ধর্ম তার অনুসারিদের একত্রিকরনের জন্য রেখেছে ব্যতিক্রম ব্যবস্থা।
হজ্ব হচ্ছে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা আর্থিক ও শারিরিক ইবাদতও বটে। হজ্বের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা করা, সংকল্প করা। শরিয়তের পরিভাষায় হজ্বের মাস সমূহে বিশেষ কিছু কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে নির্দ্দিষ্ট কিছু স্থানের যিয়ারত করাকে হজ্ব বলে।
হজ্বের মাসসমূহঃ- শাওয়াল, যিলক্বাদাহ ও যিলহাজ্জার দশ দিন। বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে হজ্ব যখন ওয়াজিব হয় তখনই পালন করা এবং একবারই পালন করা ফরয।
হজ্ব ফরয হওয়ার শর্ত আটটিঃ (১) মুসলমান হওয়া (২) জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া (৩) বালেগ হওয়া (৪) স্বাধিন হওয়া (৫) হজ্বের সময় হওয়া (৬) মধ্যম ধরনের ব্যয় হিসেবে সফরের ব্যয় বহনের সামর্থ থাকা, যদি হজ্ব পালনকারি মআ শরিফে অবস্থান করে তবুও (৭) যারা মক্কা শরিফের বাহিরে থাকেন তাদের জন্য হজ্ব পালনের শর্ত হল মালিকানা বা ভাড়া সূত্রে স্বতন্ত্রভাবে একটি বাহন বা অন্যকিছু ব্যবহারের সামর্থ থাকা যেমনঃ আমাদের দেশের হাজ্বিগণ বিমান ব্যবহার করে থাকেন। তবে কেউ যদি বিনিময় ছাড়া তার বাহন বা সওয়ারি ব্যবহারের অনুমতি দেয় তাহলে তা সামর্থ হিসেবে গণ্য হবে। যারা মক্কার আশেপাশে অবস্থান করেন, তাদের উপর তখন হজ্ব ফরয হয়। যখন তারা কষ্ট সহ্য করে নিজ শক্তিতে পায়ে হেটে হজ্ব করতে পারে। কিন্তু হাটতে সক্ষম না হলে সেই ব্যক্তি মক্কার অধিবাসি হোক বা না হোক তার জন্য অবশ্যই বাহনের প্রয়োজন হবে। (৮) অমুসলিম দেশে ইসলাম গ্রহনকারি ব্যক্তির “হজ্ব ইসলামের একটি রুকন (ফরয)”একথা জানা থাকা বা সে ব্যক্তি মুসলিম দেশের অধিবাসি।
হজ্ব ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাঁচটিঃ (১) সুস্থ থাকা (২) হজ্বে যাওয়ার বাহ্যিক বাধা দূরিভুত হওয়া (৩) রাস্থাঘাট নিরাপদ থাকা (স্থল ও সামুদ্রিক পথে যদি অধিকাংশ লোক নিরাপদে ফিরে আসে তবেই রাস্থা নিরাপদ বলে ধর্তব্য হবে।) (৪) মহিলাগন তাদের ইদ্দত অবস্থায় না থাকা (৫) নারির বেলায় হজ্বে তার সাথে একজন মুসলমান আস্থাভাজন, জ্ঞান সম্পন্ন, বালেগ মাহরাম পুরুষ বা স্বামি থাকা। মাহরাম ব্যক্তি স্তন্যসূত্রে মাহরাম হতে পারে অথবা বৈবাহিক সূত্রেও হতে পারে।
চারটি কাজে হজ্ব পালনঃ চারটি কাজ করলে স্বাধিন ব্যক্তির হজ্বের ফরয বিশুদ্ধভাবে পালিত হয়। এক. ইহরাম। দুই. ইসলাম। এ দুটি হল হজ্বের শর্ত অতঃপর হজ্বের অপর দুই ফরয পালন করা। অর্থাৎ যিলহজ্বের নবম তারিখে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর থেকে কোরবানির দিনের ফযর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অন্তত এক মূহুর্ত আরাফাতের ময়দানে ইহরাম অবস্থায় থাকা। তবে শর্ত হল এর পূর্বে ইহরাম অবস্থায় স্ত্রী সহবাস না করা চাই। দ্বিতিয় ফরয হল তাওয়াফে যিয়ারতের অধিকাংশ চক্কর যথাসময়ে অর্থাৎ দশম তারিখের ফযরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর পালন করা।
হজ্বের ওয়াজিব সমূহঃ (১) মিক্বাত হতে ইহরাম বাধা (২) সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা (৩) যিলহজ্বের দশ তারিখে ফযরের সময় শুরু হওয়ার পর এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে মুযদালিফায় থাকা (৪) পাথর নিক্ষেপ করা (৫) হজ্বে ক্বেরান ও হজ্বে তামাত্তু পালনকারির পশু যবেহ করা (৬) মাথা মুন্ডানো বা চুল ছোট করা (৭) মাথা মুন্ডানোর কাজটি হারাম শরিফে এবং ক্বোরবানির দিন গুলোতে সম্পন্ন করা (৮) মাথা মুন্ডানোর পূর্বে পাথর নিক্ষেপ করা (৯) হজ্বে ক্বেরান ও হজ্বে তামাত্তু পালনকারির পাথর নিক্ষেপ ও মাথা মুন্ডানোর মধ্যবর্তি সময়ে পশু যবেহ করা (১০) ক্বোরবানির দিনগুলোতে তাওয়াফে যিয়ারত সম্পন্ন করা (১১) হজ্বের মাসগুলোতে সাফা-মারওয়ার মধ্যখানে সায়ী করা (১২) গ্রহনযোগ্য তাওয়াফের পর সায়ী করা। (১৩) ওযর ব্যতিত পায়ে হেটে সায়ী করা (১৪)সাফা থেকে সায়ী আরম্ভ করা (১৫) বিদায়ি তাওয়াফ করা (১৬) বায়তুল্লাহ শরিফের সবকটি তাওয়াফ হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) থেকে শুরু করা (১৭) ডান দিক থেকে তাওয়াফ শুরু করা (১৮) ওযর ছাড়া পায়ে হেটে তাওয়াফ করা (১৯) ছোট-বড় উভয় প্রকার হাদাস থেকে পবিত্র থাকা (২০) সতর ঢাকা (২১) তাওয়াফে যিয়ারতের অধিকাংশ চক্কর (ক্বোরবানির দিনগুলোতে) সম্পন্ন করার পর অবশিষ্ট চক্করগুলো সম্পন্ন করা (২২) নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা যেমনঃ পুরুষরা সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করা এবং মাথা ও চেহারা ঢাকা, মহিলারা চেহারা ঢাকা, যৌন উত্তেজক কথাবার্তা বলা, গুনাহের কাজ করা, ঝগড়া-বিবাদ করা, শিকার বা শিকারের প্রতি ইশারা করা কাউকে শিকার দেখিয়ে দেয়া ইত্যাদি।
হজ্বের কার্যাবলি পুরোপুরিভাবে সম্পাদনের পদ্ধতিঃ যখন কেউ হজ্ব করার ইচ্ছা করবে তখন সে মিক্বাত থেকে ইহরাম বাধবে। ইহরাম বাধার নিয়ম এই যে, ইহরাম বাধার প্রারম্ভে গোসল কিংবা ওযু করে নেয়া। তবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য গোসলই উত্তম। কাজেই হায়েয ও নেফাসগ্রস্থ নারীর যদি গোসল করলে ক্ষতি না হয় তাহলে গোসল করবে। নখ ও গোফ কেটে, বগলের পশম পরিস্কার করে, নাভির নিচের পশম মুড়িয়ে, গোসল করে সুগন্ধি লাগিয়ে তেল ব্যবহার করে সম্পূর্ণরুপে পরিস্কার হওয়া মুস্তাহাব। পুরুষ লোক একটি ইযার ও চাদর পরিধান করবে, যা নতুন কিংবা ধৌতকরা হতে পারে। তবে নতুন সাদা কাপড় উত্তম। চাদরটি বোতামবিহীন হতে হবে। কোন প্রকারের জোড়া বা কাপড় ছিড়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখা সম্পূর্ণ নিষেধ। এ ধরনের কাজ করা মাকরুহ। এ জন্য তার উপর ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোন কিছু ওয়াজিব হবে না।
হে হজ্ব বা ওমরাহ পালনকারি ব্যক্তি! এবার আপনি দু’রাকাত নামায পড়–ন। অতঃপর বলুন, হে আল্লাহ আমি হজ্ব পালন করার ইচ্ছা করেছি, সুতরাং আপনি আমার জন্য কাজটি সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা ক্ববুল করুন। নামাযের পর তালবিয়া পড়–ন “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদাহ, ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা”। যখন আপনি হজ্ব বা ওমরার নিয়তে তারবিয়া পড়লেন তখনই আপনার ইহরাম বাধা হয়ে গেল। সুতরাং এ সময় থেকে আপনি রাফাস তথা স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত থাকবেন। সবসময় তালবিয়া পড়–ন, তবে চিৎকার দেয়ার প্রয়োজন নেই। যার দ্বারা নিজের বা অন্যের ক্ষতি হয়। যখন আপনি মক্কায় পৌছবেন তখন আপনার গোসল ও দরজায়ে মুআল্লা দিয়ে প্রবেশ করা মুস্তাহাব।
হজ্বের প্রকারভেদঃ হজ্ব মোট তিন প্রকার। ১. হজ্বে ইফরাদ ২. হজ্বে তামাত্তু এবং ৩.হজ্বে ক্বেরান।
হজ্বে ইফরাদের পরিচয়ঃ ইফরাদ শব্দের আভিধানিক অর্থঃ একা, একাকি বা পৃথক। শরিয়তের পরিভাষায় মিক্বাত হতে শুধু হজ্বের নিয়ত করে ইহরাম বেধে শুধুমাত্র হজ্ব সম্পন্ন করার নাম ইফরাদ।
হজ্বে তামাত্তু এর পরিচয়ঃ তামাত্তু এর আভিধানিক অর্থঃ উপকারিতা অর্জন করা, উপভোগ করা। পরিভাষায় মিক্বাত হতে প্রথমে ওমরার ইহরাম বেধে তার কার্যাবলি সমাপন করে হালাল হওয়ার পর হজ্বের সময় হজ্বের ইহরাম বেধে তার আহকাম সমূহ সম্পাদন করাকে তামাত্তু বলে।
হজ্বে ক্বেরান এর পরিচয়ঃ ক্বেরানের শাব্দিক অর্থঃ মিলানো, মিশ্রন করা। পরিভাষায় মিক্বাত হতে একসাথে হজ্ব ও ওমরার নিয়ত করে ইহরাম বেধে উভয়টিকে একই ইহরামে সমাপ্ত করাকে ক্বেরান বলে।
সর্বোত্তম হজ্ব কোনটিঃ তিন প্রকারের হজ্বের মধ্যে কোনটি সর্বোত্তম তা নিয়ে ইমামদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
ইমাম আবু হনিফা (রহ.)’র মতে হজ্বে ক্বেরান হচ্ছে সর্বোত্তম হজ্ব। এরপর তামাত্তু তারপর ইফরাদ। কেননা নবিয়ে করিম (সা.) বিদায় হজ্বের সময় ক্বেরান হজ্ব করেছেন এবং তার পরিবারবর্গকেও তা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া এটা পালন করা খুবই কষ্টকর। কারণ এতে দুটি ইবাদত একসাথে করা হয়।