লাইফ কেয়ার ডায়াগস্টিক সেন্টারের নানা অসঙ্গতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর নিজেদের ধোয়া তুলসিপাতা হিসেবে উপস্থাপন করে স্থানীয় পত্রিকা
দফতরে প্রতিবাদ পাঠিয়েছিল আলোচিত প্রতিষ্ঠানটি। ম্যানেজার স্বাক্ষরিত প্রতিবাদপত্রে লাইফ কেয়ার কোন দালাল নিয়োগ করে না ও এ ধরণের কাজের সাথে কোনো প্রকার যুক্ত নয়, প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি নষ্ট করার লক্ষ্যে অসৎ উদ্দেশ্যে সংবাদটি প্রকাশ করা হয়েছিল বলে গলাবাজি করে।
কিন্তু এ ধরণের গলাবাজি মিথ্যা প্রমাণ করে সোমবার খোদ ভ্রাম্যমাণ আদালতই তাদের অসৎ কর্মকাণ্ড হাতেনাতে ধরে ফেলে রোগীদের টাকা ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা ও অর্ধলাখ টাকা জরিমানা করে। এর মধ্যে দিয়েই স্বরূপ উম্মোচন হয় প্রতিষ্ঠানটির।
ওইদিন দুপুরে যশোর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিষ্ঠানে অভিযানে গেলে নানা অনিয়মের চিত্র ধরে ফেলেন। এ প্রতিষ্ঠানকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের বহিঃবিভাগ পরিচয়ে ভাগিয়ে আনা রোগীদের সাথে কথা বলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ।
আদালত প্রতিবেদককে জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালত লাইফ কেয়ার সেন্টারের এমডি লাইলা ইয়াসমিনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের সাথে প্রতারণার অপরাধে মামলা দিয়ে এ জরিমানা করা হয়। এ সময় আদালত সেখান থেকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ১৪ জন রোগীর টিকিট উদ্ধার করে। এদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া ১৬ হাজার টাকাও উদ্ধার করা হয়। এ সময় আদালত ৮ হাজার টাকার দাবিদার পাওয়ায় তাদের টাকা ফেরত দেয়। এছাড়া বাকি ৮ হাজার টাকার দাবিদার না পাওয়ায় ওই টাকা জব্দ করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়।
যশোরের চৌগাছা উপজেলার সাজ্জাদপুর এলাকার আমির আলীর স্ত্রী ফরিদাকে ১১০০ টাকা, যশোর সদর উপজেলার উসমানপুরের ইদ্রিস আলীর স্ত্রী রেশমাকে ৭০০ টাকা, সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার খুবদিপুর গ্রামের দেদারুল আলমের মেয়ে মঞ্জুকে ১৩০০ টাকা, যশোর সদর উপজেলার উসমানপুরের নওশের আলীর ছেলে মনিরুল ইসলামকে ১৭০০ টাকা, চৌগাছা উপজেলার বলিদানপুর গ্রামের আব্দুল আলীমের ছেলে আবীরকে ১৪০০ টাকা, জোহরা খাতুনকে ৭০০ টাকা, হালিমাকে ১৩০০ টাকা, তবিবর রহমানকে ৫০০ টাকা ফেরত দেয়া হয়। ভোক্তাধিকার আইন ২০০৯ এর ৫৩ ধারায় ক্লিনিকে জরিমানা ও রোগীদের টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে।
অভিযানের সময় লাইফ কেয়ার থেকে বিক্রয়ের জন্য প্রযোজ্য না যৌন কাজে ব্যবহৃত ১০টি জি লুবিকেটিং জেল, ওষুধ ছাড়াই পরীক্ষা নিরীক্ষা লেখা একাধিক ব্যবস্থাপত্র উদ্ধার হয়।
এর আগে ভ্রাম্যমাণ আদালত যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল চত্বরে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের ৪ দালালকে আটক করে ২০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। তারা হলেন- যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের শরিফুজ্জামানের ছেলে রকিবুজ্জামান ওরফে সাচ্চু, যশোর রেলগেট এলাকার ইস্রাফিল শেখের ছেলে রুবেল শেখ,সদর উপজেলার পুলেরহাট গ্রামের হায়দার আলীর ছেলে মনিরুজ্জামান মনির ও শেখহাটি পূর্বপাড়ার জোবায়ের হোসেনের ছেলে জাফর হোসেন।
এছাড়া বখশিস বাণিজ্যের সময় হাসপাতালের জনগোষ্ঠীর সহায়তায় কর্মচারী আখতারকে টাকাসহ আটকের পর কর্তৃপক্ষের কাছ সোপর্দ করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের পেশকার জালাল উদ্দিন।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল ইসলাম জানান, যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের প্রথম গেটের গা ঘেঁষেই অবস্থিত লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটির এমডি লাইলী ইয়াসমিন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি করেন ডা. মনির হাসান। এখানে প্রতারণার ফাঁদ পেতে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ নানা অজুহাতে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। জেনারেল হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের সামনে থেকে শুরু করে লাইফ কেয়ারের গেট পর্যন্ত পোষ্য দালালের বিচরণ থাকে। দালাল একজন আরেকজনের হাতে রোগীদের তুলে দেয়। দালালরা রোগী ও স্বজনদের বলে থাকে সেটি জেনারেল হাসপাতালের বহিঃবিভাগের একটি অংশ। হাসপাতালের ২, ৪, ৬ ও ৭ নম্বর কক্ষ ওই ভবনে। সেখানে ডাক্তার রোগী দেখছেন। আর রোগীরা বিশ্বাস করে সেখানে চলে যাচ্ছে।
এমন অভিযোগের ভিত্তিতে লাইফ কেয়ারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানের সময় ভয়াবহ এই প্রতারণার সত্যতা মিলেছে। এ সময় দেখা যায় সরকারি টিকিট হাতে একাধিক রোগী সেখানে অপেক্ষা করছেন। রোগীদের কাছ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানতে পারে আদালত। তখন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া টাকা ফেরত নিয়ে প্রতারিত রোগীদের বুঝে দেয়া হয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরো জানান, এটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার হলেও চিকিৎসকের প্যাডে হাসপাতাল লিখে প্রতারিত করা হচ্ছিলো। এছাড়া পর্যাপ্ত চিকিৎসক, সেবিকা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, প্যাথলজি পরীক্ষায় অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগে ভোক্তাধিকার আইন ২০০৯ এর ৫৩ ধারায় লাইফ কেয়ারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
অভিযানে যশোর কোতয়ালি মডেল থানার ওসি (অপারেশন) সামসুজজোহা, শহরের পুরাতন কসবা ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর শিহাবুর রহমানসহ পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
কথা প্রসঙ্গে প্রতারিত রোগী যশোর সদর উপজেলার ওসমাপুর গ্রামের নওশের আলীর ছেলে মনিরুল ইসলাম জানান, তিনি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসলেও এক যুবক তাকে এখানে ডেকে আনেন। তাকে বলা হয় এটা হাসপাতালের আরেকটি কক্ষ। পরে চিকিৎসা ফিস বাবদ ২০০ ও পরীক্ষা নিরীক্ষা বাবদ ১৫০০ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। একই গ্রামের ইদ্রিস আলীর স্ত্রী রেশমা একই কথা জানিয়ে ১৪০০ টাকা হাতিয়ে নেন লাইফ কেয়ার কর্তৃপক্ষ।
যশোরের চৌগাছা উপজেলার শাহাজাদপুর গ্রামের আমির আলীর স্ত্রী ফরিদা জানান, সদর হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের সামনে থেকে তাকে ধোকা নিয়ে এখানে আনা হয়েছে। তিনি সরল মনে এখানে আসার পর নানা অজুহাতে ১১০০ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এ প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলাম। হাতিয়ে নেয়া টাকা ফেরত পেয়ে তারা খুঁশি।
এদিকে এর আগেও যশোরের তৎকালিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত লাইফ কেয়ারে অভিযান চালায়। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত দেখতে পান, বিভিন্ন মেডিকেল টেস্টের জন্য নির্ধারিত ফিস/মূল্যের প্রদর্শিত তালিকা নেই। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ মূল্য/ফিস আদায় করা হয়। এই অভিযানে পাওয়া যায় একজন ডাক্তারের স্বাক্ষরিত মেডিকেল টেস্ট রিপোর্টের প্রায় ২০০ খালি পাতা। যা পরবর্তীতে রোগীদের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়ন ছাড়াই হসপিটাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছামতো রিপোর্ট দেয়ার জন্য ব্যবহার করেন। আর্থিক জরিমানার পরও লাইফ কেয়ারের প্রতারণা থামেনি। সচেতন মহলের দাবি এ অভিযানের পরও প্রতারণা চললে লাইফ কেয়ার সিলগালা করা হোক।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার হিসেবে লাইফ কেয়ারের অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৮৩৮৩। বর্তমানে সেখানকার সাইনবোর্ড ও ব্যবস্থাপত্রে ডায়াগনস্টিকের আগে হসপিটাল লিখে কার্যক্রম প্রতারণা জোরদার করা হয়েছে। বাস্তবে হসপিটালের কোনো কার্যক্রম নেই। হসপিটালের কার্যক্রম চালুর বিষয়ে অনুমোদনও নেয়া হয়নি। বরং ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাও নবায়ন করা হয়নি। এটি একটি নাম সর্বস্ব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান। এখানে নেই বিশেষ চিকিৎসক, ডিগ্রিধারী সেবিকা, মেশিনারীজ, প্যাথলজিস্ট, ল্যাব, টেকনিশিয়ান, শয্যা ও কেবিন।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে আসা রোগীর উপর ভর করে লাইফ কেয়ার খুলে প্রতারণা করা হচ্ছিল ৷