নাটোরের রাজবাড়ি ,ছাইভাঙ্গা বিল এবং মজার এক গল্প

কবির কল্পনায় নাটোর অমর হয়ে আছে কাব্যে। প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্য্য মন্ডিত বরেন্দ্র ভূমি সংলগ্ন নাটোর জেলা। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাজবাড়িতে নেই রাজা। নেই অর্ধ বঙ্গেশ্বরী, যাকে নাটোরের মানুষজন এখনো বঙ্গমাতা বলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তবে আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের জৌলুশ। সেই ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ির ইতিহাস পাঠকদের জন্য।

সদ্য জমিদারি পাওয়া রাজা রামজীবন আর রঘুনন্দনকে তাঁদের মা আদেশ দিয়েছিলেন নিজের জন্মভূমির কোনো একটা জায়গায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে। সেই মতো বর্ষার এক দিনে তাঁরা বেড়িয়েছেন। যেখানে নৌকোয় যাতায়াতের সুবিধে বেশি, সেখানেই তৈরি হবে রাজধানী। সঙ্গে রয়েছেন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতের দল। ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা এলেন ছাইভাঙ্গা বিলে। বিলের মধ্যে একটা জায়গায় তাঁরা দেখলেন, দুটো সাপ বিল পাড় হচ্ছে সাঁতরে। আর একটা ব্যাং গিলে খাচ্ছে ছোটো একটি সাপকে। এসব দেখে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা জানালেন, রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই বিলের ওপরই। নাটোর শহরের গড়ে ওঠা নিয়ে এই গল্প প্রচলিত আছে মানুষের মুখে মুখে। সাপ আর ব্যাং নিয়ে গল্পকথার ঐতিহাসিক সত্যতা বিচার করা সম্ভব হয়নি, তবে ইতিহাস এটুকু বলে যে ছাইভাঙ্গার বিল ছিল পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের সম্পত্তি। রঘুনন্দন আর রামজীবন রাজা দর্পনারায়ণের কাছে এই বিল রায়তি স্বত্বে পত্তনির আবেদন করেন। নতুন রাজাকে রাজা দর্পনারায়ণ জমিটি ব্রহ্মোত্তর দান করেন। রামজীবন সেখানেই তৈরি করান তাঁর রাজবাড়ি। জায়গাটার নামকরণ করেন ‘নাট্যপুর’ অর্থাৎ আজকের নাটোর।
১৭০৬-১৭১০ সাল নাগাদ বানানো হয়েছিল নাটোরের রাজবাড়ি। বাড়িটার ডাক নাম ছিল পাগলা রাজার প্রাসাদ’। ১৭৩৪ সালে মারা যান রামজীবন। তার আগেই রাজা রাম জীবনের দত্তক ছেলে রামকান্তের বিয়ে হয়েছিল রানি ভবানীর সঙ্গে। রাজা রামজীবনের মৃত্যুর পরে রামকান্ত নাটোরের রাজা হন। ১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্ত মারা গেলে নবাব আলিবর্দি খাঁ জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন রানি ভবানীর ওপর। রানি ভবানীর রাজত্বকালে তার জমিদারি এখনকার রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রায় ৫৪ বছরের শাসনে (১৭৪৮-১৮০২) তিনি নাটোরের রাজ পরিবারকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। অর্ধেক বাংলায় রাজত্ব করতেন বলে তাঁকে ‘অর্ধবঙ্গেশ্বরী’ বলে ডাকা হত। রানির মৃত্যু হলে জমিদারির দায়িত্ব পান তাঁর দত্তক ছেলে রামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণের পর তাঁর দুই ছেলে শিবনাথ এবং বিশ্বনাথ ১৭৭৮ সালে নাটোর জমিদারবাড়ির যৌথ মালিক হন। পুরো জমিদার বাড়ি তাদের তাঁদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। তখন থেকে রাজবাড়িতে বড়ো ছেলের অংশকে বলা হত ‘বড়ো তরফ’ আর ছোটো ছেলের অংশকে ‘ছোট তরফ’ বলা হত। রাজবাড়ির চারদিক ছিল পরিখায় ঘেরা। বড়ো তরফের প্রাসাদ, ছোটো তরফের প্রাসাদ, বড়ো তরফের কাছারি ও প্রহরীর ঘর, ছোটো তরফের কাছারি, রানি ভবনের মতো নয়টি ভবন ছিল গোটা রাজবাড়িতে। এখন গোটা প্রাসাদ এলাকায় মোট ৫টি বড় আকারের পুকুর আছে। রাজবাড়ির ভেতরে আছে চারটে মন্দির। আনন্দময়ী কালীবাড়ি, শ্যামসুন্দর মন্দির, সর্বমঙ্গলা মন্দির আর তারকেশ্বর শিব মন্দির। আর রয়েছে বেশ কিছু পুরোনো গাছ। নাটোরের রাজবাড়ি যেতে হলে নাটোর শহর থেকে সরাসরি রিক্সা বা টেম্পো নিতে হবে। ঢাকা থেকে ট্রেন এবং বাস – দুটোতেই পৌঁছনো যায় নাটোর।