পুলিশের চাকুরি কথা শুনলেই লাখ লাখ টাকার খেলা প্রায়ই শোনা যেত। প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে চাকুরি প্রার্থীদের নিঃস্ব হবার উদহারনও নেহায়েত কম নয়। সেখানে নিয়ম আনুযায়ী মাত্র ১০৩ টাকা দিয়ে পুলিশের চাকুরি পাওয়ার কথা রীতিমত অবিশ্বাস্যই বটে। সেই অবিশ্বাস্য কাজই করেছেন লালমনিরহাট পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক। নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে তাঁর প্রত্যক্ষভাবে তদারকিতে মাত্র ১০৩ টাকায় ২৭ জন যোগ্য প্রার্থীরাই কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়েছেন। সবাই বলে টাকা ছাড়া পুলিশের চাকুরি হয় না। ব্যাংক ড্রাফটটা তখনও করিনি। আমাদের এলাকায় ‘শুধুমাত্র যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ কনস্টেবলে নিয়োগ দেয়া হবে’ -এমন মাইকিং শোনার পর বাড়ি থেকে সবাই প্রার্থী হতে সাহস দেয়। এখনও বিশ^াস করতে পারছি না যে বিনা টাকায় চাকুরিটা আমার হয়েছে।” এভাবেই পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকুরি পাওয়া লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাশিরাম গ্রামের মেহের আলীর পুত্র এনামুল হক তার আনন্দঘন অনুভূতি জানান। একই অনুভূতি জেলা শহরের খোচাবাড়ি এলাকার আনোয়ার হোসাইনের পুত্র মনিরুল ইসলামের। দিনমজুর বাবার তিন সন্তানের বড় ছেলে মনিরুল। অভাবের সংসারে টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। সদ্য সমাপ্ত এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন মনিরুল। মনিরুল বলেন, “আজকেও পুলিশ সুপার মহোদয় আমাদের ডেকে বলেছেন যদি কেউ এখনও কোনো টাকা চায় সোজা আমাকে ফোন করে জানাবেন। কি বলে যে পুলিশ সুপার স্যারকে কৃতজ্ঞতা জানাবো তার ভাষা আমার জানা নেই।” সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের রতিপুর গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক বিমল চন্দ্র রায়। সামান্য জমিতে চাষবাদ করে তিন মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে আসছেন। বড় মেয়ে প্রমীলা মেধাবী ছাত্রী। স্থানীয় অনেকের কাছে শুনেছেন লালমনিরহাটের বর্তমান পুলিশ সুপার অত্যন্ত সৎ। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শুধু শারীরিক ও মেধার যোগ্যতায় চাকুরি দেবেন। সেই বিশ^াসে প্রমীলাকে পাঠিয়ে দেন পরীক্ষা দিতে। ঘুষ ছাড়া মেয়ের চাকুরি হওয়ায় ভীষণ খুশি বিমল। বলেন, “ভেবেছিলাম আমার তো টাকা পয়সা নাই, মেয়ের চাকুরিও এ জীবনে হবে না।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অপার ইচ্ছায় আমার মেয়েটা আজ বিনা পয়সায় পুলিশের চাকুরি পেয়েছে।” এভাবে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কনস্টেবল হতে পেরে যারপরনাই খুশি চাকুরি প্রাপ্তরা। অভিভাবকদের কাছে ঘটনাটি এখনো ধাঁধার মতো। পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য একটি অবলম্বন খুঁজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা অনেকে। মনিরুল, এনামুল, প্রমীলার মতই কোনো ঘুষ না দিয়ে, কোনো প্রকার তদ্বির না করেই লালমনিরহাটে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগ পয়েছেন ২৭ নারী-পুরুষ। সংশ্লিষ্ট জানান, চলতি বছর এ জেলায় পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় সহশ্রাধিক প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হন এক শত ৬৫ জন। তাদের মধ্য থেকে চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়ে কনস্টেবল পদে চাকুরি পেয়েছেন ২৭ জন। এদের মধ্যে সাধারণ কোটায় ১০ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৫ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী এবং পোষ্য কোটায় ২ জন চাকুরি পেয়েছেন। এর আগে গত ২৫ মে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ‘ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল’ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর ২৫ জুন জেলা পুলিশ লাইন্সে সকাল ৮টা থেকে রাত পর্যন্ত শারীরিক মাপ ও শারীরিক পরীক্ষার প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়। ২৭ জুন অনুষ্ঠিত হয় লিখিত পরীক্ষা।
পরে ১ জুলাই লিখিত ফলাফল প্রকাশের পর ওই দিনই মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সবশেষ ২ জুলাই চুড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। পুলিশের চাকরিতে এমন পরিবর্তনে রীতিমত হতবাক স্থানীয় সচেতন মহল। সবার প্রত্যাশা সততার এমন নিদর্শন কর্মক্ষেত্রে তারাও নিজেদেরকে উজাড় করে দিবেন দেশ ও জাতির জন্য। সাপ্তাহিক লালমনিরহাট বার্তার সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম কানু বলেন, দেশের পিছিয়ে পড়া এ জেলার দরিদ্র পরিবারের মেধাবিরা কোন ঘুষ ছাড়াই চাকরি পাওয়ার যে দৃষ্টান্ত তৈরি হল তা সব সরকারি চাকরিতে করা হলেসোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজ সার্থক ও সহজ হবে। জানা গেছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি চাকুরিতে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার অংশ হিসেবে নানাভাবে প্রচারণা চালায় লালমনিরহাট পুলিশ। কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় কোনো প্রতারক চক্রের সাথে লেনদেন না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এর অংশ হিসেবে নিয়োগ পরীক্ষার আগে থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে গোটা জেলায় টানা কয়েকদিন মাইকিং করা হয়। এছাড়া জেলা পুলিশের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রতিদিনই দেয়া হয় নানা সচেতসতামূলক পোস্ট। ঘুষ ছাড়া ও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি পাওয়া কনস্টেবলরাও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে বলেছেন, চাকুরি জীবনে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে দেশ ও জনগণের কল্যাণ করতে চান তাঁরা। সততার দৃষ্টান্ত রেখে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক ও জেলা পুলিশের টিমকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলেননি অভিভাবক ও চাকুরি প্রাপ্তরা। পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক বলেন, গত কয়েকবছর ধরে আমরা এই প্রচেষ্টা চালাচ্ছি যে, যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয়। যাতে দালালের খপ্পড়ে না পড়ে। এবার এর প্রভাবটা বেশি পড়েছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ছিল যাতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন হয়। সততার সাথে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে রশিদুল হক বলেন, সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখে পাশে থাকতে হবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। সততার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যাতে দেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। দরিদ্র, দিন মজুর ও কৃষক পরিবারের চাকুরি পাওয়া সন্তান ও অভিভাবকরা চান এ স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সম্পন্ন হোক সকল নিয়োগ প্রক্রিয়া।