শৈশব মানেই রঙিন কিছু স্মৃতি। আবছা এ স্মৃতিগুলোই সারা জীবন মনের পাতায় পাতায় আঁচড় কাটে। কৈশোরের এ সময়ে মেয়েদের যেমন মানসিক পরিবর্তন আসে তেমনি আসে শারীরিক পরিবর্তন। নিজের কথা কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মনের কথাগুলো ভাগাভাগি করে নিতে পরিবারকে এ সময়ে বন্ধুরূপে পাওয়া জরুরি। এতে করে জেনে নিতে পারবে তার না জানা অনেক প্রশ্নের উত্তর।
বয়ঃসন্ধি একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি শিশুর শরীরে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের লক্ষণ দেখা দেয়। সে প্রজননে সক্ষমতা লাভ করে। শিশু স্বাভাবিক নিয়মে বড় না হয়ে সময়ের আগে পূর্ণতা পেলে তার নাম প্রিকোসিয়াস পিউবার্টি অথবা অকাল বয়ঃসন্ধি। এটি এক ধরনের শারীরিক সমস্যা। বয়ঃসন্ধি শুরু হয় মস্তিষ্ক থেকে গোনাডে (ছেলেদের ক্ষেত্রে শুক্রাণু, মেয়েদের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়) সংকেত যাওয়ার মাধ্যমে। এই সংকেত এস্ট্রাডিওল গেলে হরমোন উৎপাদন শুরু হয়। এই হরমোনের প্রভাবে বয়ঃসন্ধির লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
সাধারণত মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে ৯ বছর বয়সে আর ছেলেশিশুর ১১ বছর বয়সে এই পরিবর্তন দেখা দেয়। মেয়েশিশুর বেলায় ৮ বছরের আগে আর ছেলেশিশুর ৯ বছরের আগে বয়ঃসন্ধির লক্ষণগুলো দেখা দিলে সতর্ক হতে হবে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের প্রিকোসিয়াস পিউবার্টি বেশি দেখা যায়।
এ রকম একটি প্রতিবেদন ওঠে এসেছে বিবিসিতে। ছয় বছর বয়সী একটি কন্যা শিশুর মা অর্চনা (ছদ্মনাম)। তার মেয়ের শরীরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেন যা অস্বাভাবিক মনে হয় তার এবং এতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি এত অল্প বয়সে এটা দেখে ভয় পেয়েছিলাম। সে ছোটখাটো বিষয়ে রাগ করতে শুরু করে। এই পরিবর্তনগুলো আমাকে উদ্বিগ্ন করছিল।’
অর্চনা পশ্চিম ভারতের সাতারা জেলার একটি গ্রামে পরিবারের সঙ্গে থাকেন তিনি। স্বামী এবং দুই সন্তান- একটি ছেলে আর একটি বড় মেয়ে নিয়ে স্থানীয় খামারে নির্মিত একটি ছোট বাড়িতে থাকেন তিনি।
তার ছোট্ট মেয়েটিকে যখন বয়সের চেয়ে বড় দেখাতে শুরু করে, তখন তিনি তাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
‘এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল’
এদিকে, দিল্লিতে বসবাসকারী রাশিও তার মেয়ের শরীরে পরিবর্তন দেখতে পেয়েছিলেন, তবে সেগুলিকে অবশ্য স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল তার।
তার ছয় বছর বয়সী মেয়ের ওজন ৪০ কেজি হয়ে যায় এবং তিনি মেয়েকে একটি ‘স্বাস্থ্যবান শিশু’ বলেই মনে করেছিলেন।
কিন্তু একদিন রাশির মেয়ে হঠাৎ রক্তক্ষরণের অভিযোগ করে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানা গেল তার মেয়ের মাসিক শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন ছিল। আমার মেয়ে বুঝতে পারছিল না তার সাথে কী হচ্ছে।’
সেই একই সময়ে স্থানীয় এক চিকিৎসক অর্চনাকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলেন।
পুনের মাদারহুড হাসপাতালের চিকিৎসক সুশীল গারুড় বলেন, ‘অর্চনা যখন তার মেয়েকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, পরীক্ষা করে আমরা তার বয়ঃসন্ধির সমস্ত লক্ষণ দেখতে পেয়েছি। তার শরীরের গঠন ছিল ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর মত এবং যার পিরিয়ড যেকোনো সময় শুরু হতে পারে।’
ডা. গারুড় জানান, মেয়েটির মধ্যে হরমোনের মাত্রা তার বয়সের তুলনায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, যার অনেক কারণ থাকতে পারে।
তিনি বলেন, অর্চনা আমাকে বলেছিলেন যে তার বাড়িতে দু’টি ৫ কেজি কীটনাশকের ক্যানিস্টার রাখা আছে এবং তার মেয়ে সেগুলোর চারপাশে খেলতে থাকে। তাই এটি তার হরমোন পরিবর্তনের একটি প্রধান কারণ হতে পারে।’
শিশুদের মধ্যে এমন অকাল পরিবর্তনকে বলা হয় অকালপক্ক বয়ঃসন্ধি বা প্রারম্ভিক বয়োঃসন্ধি, তিনি যোগ করেন।
বয়ঃসন্ধি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি ছেলে অথবা মেয়ের শরীরে নানা পরিবর্তন ঘটে, তাদের যৌনাঙ্গের বিকাশ ঘটে এবং তারা প্রজননে সক্ষম হয়।
এ সময় বেশিরভাগ ছেলেদের দাড়ি ও নিম্নকেশ দেখা দেয় এবং তাদের কণ্ঠস্বর গভীর হতে শুরু করে। অন্যদিকে, মেয়েদের নিম্নকেশ, স্তনের আকার পরিবর্তন এবং তাদের মাসিক শুরু হয়।
মেয়েদের ৮ থেকে ১৩ এবং ছেলেদের ৯ ও ১৪ বছর বয়সের মধ্যে যে কোনও সময়ে বয়ঃসন্ধি শুরু হওয়া স্বাভাবিক।
ডা. বৈশাখী রুস্তেগী একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং হরমোন-সম্পর্কিত অসুস্থতা বিশেষজ্ঞ। গত কয়েক বছরে মেয়েদের মধ্যে এক ধরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমরা দেখতাম যে মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের প্রথম লক্ষণ দেখা যাওয়ার ১৮ মাস থেকে তিন বছর পর তাদের পিরিয়ড শুরু হতো। কিন্তু এখন শারীরিক পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা দেওয়ার তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই তাদের পিরিয়ড শুরু হচ্ছে। ছেলেদের এখন বয়ঃসন্ধি শুরুর এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে দাড়ি ও গোঁফ বাড়তে শুরু করেছে, যেখানে আগে চার বছর সময় লাগত।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ডিপার্টমেন্টের চিকিৎসক সুচিত্রা সার্ভি তার গবেষণায় দেখেছেন যে প্রাথমিক বয়ঃসন্ধির ঘটনা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ ইন রিপ্রোডাক্টিভ অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ (এনআইআরআরসিএইচ) পরিচালিত দুই হাজার মেয়ের উপর চালানো একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মায়েরা প্রায়ই মেয়েদের বয়ঃসন্ধির লক্ষণ বুঝতে ব্যর্থ হন।
সংস্থাটি নয় বছরের কম বয়সী মেয়েদের অকালপক্ক বয়ঃসন্ধির কারণ ও ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করছে।
মুম্বাইয়ের বাই জেরবাই ওয়াদিয়া হাসপাতাল ও আইসিএমআর ২০২০ সালে, ছয় থেকে নয় বছর বয়সী মেয়েদের জন্য একটি অকালপক্ক বয়ঃসন্ধি শিবির স্থাপনে সহযোগিতা করেছিল।
হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক সুধা রাও বলেন, ‘ছয় থেকে নয় বছরের মধ্যে বয়সী ৬০টি মেয়ে এমন বয়ঃসন্ধির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল এবং মনে হচ্ছিল যে এদের কারও কারও যে কোনও সময় মাসিক শুরু হয়ে যেতে পারে।’
অকালপক্ক বয়ঃসন্ধির কারণ কী?
চিকিৎসকরা বলেছেন, অকালপক্ক বয়ঃসন্ধির পেছনে কোনো একক কারণকে দায়ী করা যায় না, বরং এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে, এটি নিয়ে গবেষণা চলছে।
তারা বিশ্বাস করেন যে কীটনাশক, খাদ্যে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভ বা খাদ্য সংরক্ষণকারী রাসায়নিক, দূষণ ও স্থূলতা সম্ভাব্য কারণগুলির অন্যতম।
চিকিৎসক প্রশান্ত পাতিল, যিনি মুম্বাইতে মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যাটির বিষয়ে গবেষণা করছেন, তার মতে, স্থূলতা অকালপক্ক বয়ঃসন্ধির সবচেয়ে বড় কারণগুলির একটি এবং কোভিড -১৯ মহামারি চলাকালীন শিশুদের মধ্যে স্থূলতা বৃদ্ধির কারণে এই সমস্যাটিও বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৩৯ কোটিরও বেশি শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের (পাঁচ থেকে ১৯ বছর বয়সী) ওজন বেশি ছিল, যাদের মধ্যে ১৬ কোটিরই অতিরিক্ত স্থূলতার সমস্যা ছিল।
স্থূলতা একটি দীর্ঘস্থায়ী জটিল রোগ যা অত্যধিক চর্বি জমা হওয়াকে বোঝায়, এটি স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।
এটি বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) দেখে পরিমাপ করা হয়, যাতে শিশু বা কিশোরের জন্মের সময় লিঙ্গ, বয়স, ওজন ও উচ্চতা অন্তর্ভুক্ত থাকে।
মোবাইল ফোন, টিভি বা অন্যান্য স্ক্রিনের অত্যধিক ব্যবহার এবং ব্যায়ামের অভাবকেও অকালপক্ক বয়ঃসন্ধির সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণ মনে করা হয়।
ডা. বৈশাখী বলেন, গত দুই বা তিন বছর ধরে, তার বহির্বিভাগে প্রতিদিন মেয়েদের পাঁচ থেকে ছয়টি মাসিকের ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, ‘আমি এমন ঘটনাও পেয়েছি যেখানে মায়েরা বলেছেন যে তারা এপ্রিলে মেয়ের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন এবং এরপর জুন-জুলাই মাসে মাসিক শুরু হয়ে গেছে। এখন ছেলেদের ক্ষেত্রেও অকালপক্ক বয়ঃসন্ধি দেখা যাচ্ছে।’
ডা. বৈশাখীর মতে, স্ক্রিন টাইম পরোক্ষভাবে অকালপক্ক বয়ঃসন্ধিকে প্রভাবিত করে।
অর্চনা ও রাশি, উভয়ের কন্যা শিশুই পিরিয়ড অন্তত ১০ বা ১১ বছর বয়স পর্যন্ত বিলম্বিত করার জন্য চিকিৎসাধীন রয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের যে বর্তমান বয়স, সেটা পিরিয়ডের সময় নিজেদের যত্ন নেওয়া এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট পরিপক্ক নয়।
উভয়ের চিকিৎসকই বলেছেন, যে সমস্ত মেয়েরা এমন অকালপক্ক বয়ঃসন্ধির মধ্য দিয়ে যায়, তাদের মানসিক সমস্যা থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই মেয়েদের আজীবনই শারীরিক বৈশিষ্ট্যজনিত সমস্যা থাকতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সমবয়সীদের মাধ্যমে বুলিং-এর শিকার হয় তারা, অর্থাৎ অস্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তনের জন্য সমবয়সীরা নানাভাবে উত্যক্ত করে থাকে এই মেয়েদেরকে।