নাসিম উদ্দীন নাসিম
একসময় নাটোরের গ্রামাঞ্চলের আনাচে কানাচে প্রায় অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকতো কৃষি জমির পাশেই জলমগ্ন জমি। বর্ষাকাল ছাড়াও বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকায় সেখানে কোন প্রকার ফসলের চাষাবাদ হতো না বললেই চলে। এখন সেই জলমগ্ন প্রতিত জমিতে বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ হচ্ছে পানিফল। ফলে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন কৃষকরা।
পাশাপাশি প্রাকৃতিক উৎস হতে ওই জমি থেকে দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আবার পানিফল চাষাবাদের সাথে মাছ চাষও করছেন কেউ কেউ। ফলে জলমগ্ন এসব প্রতিত জমি কৃষকদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এক বড় উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে সহযোগিতা প্রদান করা হলে পানিফল চাষাবাদ আরো লাভজনক হবে দাবি কৃষকদের।
কৃষি বিভাগ বলছেন, দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানোসহ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দেশের কোন জমি আর পতিত রাখা যাবে না। জমিগুলো কৃষিকাজের জন্য সময়োপযোগী ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কৃষি অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হবে দেশ। এজন্য কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শ প্রধান সহ সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় এবার জলমগ্ন ১০ হেক্টর জমিতে পানি ফলের চাষাবাদ হয়েছে। তবে জেলার সদর উপজেলা, নলডাঙ্গা, সিংড়া ও গুরদাসপুর উপজেলায় বেশি পরিমাণ চাষাবাদ হয়েছে পানিফল। অন্যান্য উপজেলায় অপেক্ষাকৃত একটু কম চাষাবাদ হয়েছে। সুত্র জানায়, জলমগ্ন এসব জমিতে প্রায় সারা বছর পানি থাকে। এসব জমিতে জৈষ্ঠ্য মাসে পানি ফলের চারা রোপন করা হয়। চার মাস পর থেকে ফল আসা শুরু হয় এবং আর্শ্বিন মাসের প্রথম থেকে ফল উত্তোলনসহ বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়। পানিফল চাষাবাদ প্রক্রিয়া সহজ এবং উৎপাদন খরচও কম। ঠিকমতো ফসলের পরিচর্যা করা হলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৫ মন ফলন পাওয়া যায় ।
সদর উপজেলার বরভিটা-দিয়ারভিটা গ্রামের কৃষক হযরত আলী জানান, এবছর তিনি চার বিঘা জমিতে পানি ফলের চাষবাদ করেছেন। এজন্য তিনি বাড়ির পাশে জলমগ্ন জমি বেছে নেন। সেখানে চারা রোপনের চার মাস পর ফল আসা শুরু হয়েছে। এক থেকে দুই দিন পর পর দুই মন করে পানিফল উত্তোলন করেন। পরে স্থানীয় বাজারে এবং জমিতেই এসব পানিফল পাইকারি ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। আর স্থানীয়ভাবে খুচরা বিক্রি করেন কেজি প্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। পানিফল চাষাবাদ মোটামুটি লাভজনক।
একই এলাকার অপর কৃষক মোঃ আসাদ জানান, বর্ষাকালীন সময়ের জন্য বিঘা প্রতি ১২০০ টাকা দরে দেড় বিঘা জমি লিজ নিয়ে পানিফল চাষাবাদ করেছেন। এর ফল চাষাবাদে বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। প্রতিদিন তিনি ৩০ থেকে ৪০ কেজি করে পানিফল উত্তোলন করেন এবং গড়ে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে তা বিক্রি করছেন।
তিনি বলেন, সাধারণত পানি ফলের বিঘা প্রতি ফলন হয় ২০ থেকে ২৫ মন। খরচ বাদে প্রতি বিঘায় পানি ফল বিক্রি করে লাভ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এছাড়া ওই জলমগ্ন জমিতে পানি ফলের পাশাপাশি মাছও চাষ করা যায়। তা না করা হলেও প্রাকৃতিক উৎস থেকে দেশিও প্রজাতির হরেক রকম মাছ পাওয়া যায়। যা পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে বাজারজাত করা যায়। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি জলমগ্ন এসব জমিতে পানিফল চাষাবাদ করে আসছেন।ভবিষ্যতে পানিফল চাষাবাদের পরিধি বাড়াতে চান ।
দিয়ারভিটা গ্রামের কৃষক মোঃ আক্তার হোসেন জানান, ৪ বিঘা জমিতে এবার পানি ফলের চাষাবাদ করেছেন। পরিচর্যা, বালাইনাশক ভিটামিন ঔষধ ছাড়া তেমন একটা খরচ নেই। এ ফসল চাষাবাদে কোন রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না। তিনি গত ১০ বছর ধরে বোনা আমন ধান চাষাবাদের পাশাপাশি জলমগ্ন পতিত জমি ও পানিতে নিমজ্জিত নিচু জমিতে পানিফল চাষাবাদ করে আসছেন। তার এই চাষাবাদ দেখে এলাকার অনেকেই এখন পানিফল চাষাবাদ করছেন। তার মতে শুধুমাত্র দিয়ার ভিটা গ্রামে ভেদরার বিলে ৩০ থেকে ৩৫ চাষি পানিফল চাষাবাদ করছেন।
কৃষক শরিফুল ইসলাম, হাবলু, রমজান আলী, আমিন ও রহিম জানান, তারা প্রত্যেকে দুই থেকে তিন বিঘা করে পানিফলের চাষাবাদ করেছেন। এভাবে তারা গত ৭-৮ বছর ধরে পানিফল চাষাবাদ করছেন। এ পানিফল চাষাবাদ খরচ ও পরিশ্রম দুটোই কম লাগে। এছাড়া বর্ষাকালে অবসর সময় কাটে। এ কাজে শ্রমিক তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। নিজেরাই করা যায় পাশাপাশি দুই একজন শ্রমিক নিয়ে কাজ সম্পন্ন করা যায়।
স্থানীয় শ্রমিক মোঃ সুকেল জানান, পানিফল চাষাবাদের কারনে এই এলাকার অন্তত ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এজন্য প্রতিজন শ্রমিক ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক ও ১০০ টাকা খাওয়া বাবদ পেয়ে থাকেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তারা এ কাজে নিয়োজিত থাকেন। একই কথা জানালেন হাপু নামে অপর এক শ্রমিক।
সিংড়া উপজেলার কৈগ্রামের কৃষক জানান, দুই যুগ ধরে এ গ্রামের অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন কৃষক জলমগ্ন প্রতিত জমি, পুকুর ডোবা ও নালায় পানি ফলের চাষাবাদ করে আসছেন। এছাড়া বন্যা কবলিত এলাকায় যেসব জমি পানিতে তলিয়ে থাকে, এমন জমিতে পানিফল চাষাবাদ করা যায়। তিনি বলেন, শীতের শুরুতে পানিফলের চাহিদা বেশি থাকে। তিন মাস এই ফল পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রতি মন পানিফল ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। আগে শখের বসে পানিফল চাষাবাদ করেছেন। এখন তারা বাণিজ্যিকভাবে পানিফল চাষাবাদ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, পানিফল একটি অল্প সময়ী ও স্বল্প মেয়াদী অর্থকরী ফসল। এ ফসলে পোকার উপদ্রব কম হয়। চাষাবাদে ফলন ভালো হয়, দামও অনেক বেশি এবং বাজারে এর বেশ চাহিদা রয়েছে । খেতেও অনেক সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ রয়েছে । এ ফল খেলে মানুষের পানি শূন্যতা দূর করে। এজন্য এ পানিফল চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে।
তিনি বলেন, সাধারণত পুকুর, ডোবা-নালায় যেখানে ধান ও মাছ চাষ হয় না। সেখানে পানিফল চাষ করে সহজেই একজন আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। ইতোমধ্যে নাটোর জেলায় পানিফল চাষাবাদে কৃষকরা সফলতা পেয়েছেন। আর পানিফল চাষাবাদ উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগ থেকে মাঠ দিবসের মাধ্যমে নানা রকম পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।