মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চার পদক্ষেপ সরকারের

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চার পদক্ষেপ বাস্তবায়নে তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে এগুলো বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অসহযোগিতা। সুযোগ বুঝে অসাধু ব্যবসায়ীদের বেশি মুনাফার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিভিন্ন স্তরে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এসব কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে।

এসব সমস্যা বিগত সরকারের তৈরি। কিন্তু সেগুলো এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার, টাকার প্রবাহ হ্রাস, শুল্ক কমানো, সুদের হার বৃদ্ধি এবং বাজার তদারকি জোরদারের মতো চার পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলোসহ প্রয়োজনীয় আরও উদ্যোগের ফলে মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী।

বিশ্লেষকদের মতে, সরকারকে এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়। এজন্য শিল্পের কাঁচামাল আমদানির পথ অবারিত রাখতে হবে। উৎপাদন খাতে টাকার জোগান বাড়াতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থায় সব ধরনের বাধা অপসারণ করতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী সন্দেহভাজন বা পলাতক তাদের বিশেষ তদারকির আওতায় আনতে হবে। যাতে বাজারে পণ্যে মূল্য বাড়াতে তারা কারসাজি করতে না পারে। পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে হবে।

তারা আরও বলেছেন, সরকার পণ্যমূল্য কমাতে আমদানি শুল্ক কমাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব নয়। অতীতে এ ধরনের পদক্ষেপ বাজারে কোনো সুফল বয়ে আনেনি। শুল্ক কমানোর সুফল পেতে হলে প্রয়োজন যথাযথভাবে বাজার তদারকি। এ কারণে সরকার বাজার মনিটরিং জোরদারের নির্দেশ দিয়েছে। তারা বলেন এখনই শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ যেভাবে পণ্যমূল্য বাড়ছে তাতে আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়তে পারে। সরকার এখনই সতর্ক না হলে মার্চে শুরু হওয়া রমজানে বাজার পরিস্থিতি ভোক্তার জন্য পীড়াদায়ক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীসহ মাঝারি ও ছোট বেশ কিছু ব্যবসায়ী পলাতক রয়েছেন। তারা বিদায়ি সরকারের ঘনিষ্ঠ বা সরাসরি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যে কারণে গ্রেফতারের ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। তারা পেছন থেকে কোনো ধরনের কলকাঠি নাড়ছেন কিনা তা জোরালোভাবে মনিটর করার জন্য বিশ্লেষকরা সরকারকে পরামর্শ দেন।

ব্যাংক খাত থেকে টাকা পাচার বন্ধ ও সন্দেহজনক লেনদেন রোধে অনেক ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব জব্দ বা স্থগিত করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত করা হয়েছে। এতে ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছে না। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে প্রতিষ্ঠানিক কোনো কোম্পানির হিসাব জব্দ করা হয়নি। কিন্তু ব্যাংকগুলো অতি সতর্কতা হিসাবে অনেক প্রতিষ্ঠানের এলসি খুলছে না নিয়মিত। আগের এলসির দায়ও শোধ করতে দেরি করছে। তাদের সন্দেহ এই প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলোকে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয়েছে, কোনো কোম্পানির এলসিসহ বাণিজ্যিক লেনদেন বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। তবে কোনোভাবেই যাতে টাকা পাচার না হয় সেটি ব্যাংকগুলোকেই নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ব্যাংক তা নিশ্চিত করতে পারছে না। কারণ কোম্পানি পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত তারাই এখন পালিয়ে যাচ্ছেন। এখন সরকারের পক্ষ থেকে কোম্পানিগুলোর কাঁচামাল আমদানি, পাইপলাইনে থাকা কাঁচামাল, উৎপাদন, বিপণন এসব তথ্য সাপ্তাহিক ভিত্তিতে তদারকি করা দরকার। এসব খাতে ঘাটতি হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাহলে উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক হতে পারে। এছাড়া যারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দাম বাড়াচ্ছে আগে তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বন্যার কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এসব কারণেও বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সূত্র জানায়, সরকারের কেন্দ্রীয়সহ স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা এখনও ঠিকভাবে কাজ করছে না। এতে তদারকি ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়েছে। যে কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার তথ্যের ঘাটতিতে সঠিক পদক্ষেপও নেওয়া যাচ্ছে না। সরকার এখন পণ্যের দাম কমাতে শুল্ক কমাচ্ছে।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৈশ্বিক মন্দা শুরুর আগে দেশে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যেই ছিল। মন্দার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী এ হার বাড়তে শুরু করে। দেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার এখন অনেকটা কমে এসেছে। জুনে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ১ শতাংশে ওঠেছিল। আগস্টে তা কমে ১১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। সেপ্টেম্বরে তা ১০ দশমকি ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। এ হার ক্রমশ কমছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক দেশেই কমে গেছে। এর মধ্যে ভুটানে ২ দশমিক ৩ শতাংশ, ভারতে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, নেপালে ৪ দশমিক ১ শতাংশ নেমেছে। অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত পাকিস্তানে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে। অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়া শ্রীলংকা ইতোমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করেছে। মূল্যস্ফীতির হারও কমে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছে।

অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে ইন্দোনেশিয়ায় ৩ দশমিক ৪ শতাংশে, মিয়ানমারে ৬৬ শতাংশ থেকে কমে ৫৮ শতাংশে, ব্রাজিলে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে, চীনে ২ দশমিক ৯ শতাংশে, মালয়েশিয়ায় ১ দশমিক ৬ শতাংশে, মালদ্বীপে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে, থাইল্যান্ডে ১ দশমিক ৮ শতাংশে, কানাডায় ২ দশমিক ৭ শতাংশে, ফ্রান্সে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশে, জার্মানিতে ১ দশমিক ৫ শতাংশে, ইতালিতে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশে, জাপানে ২ দশমিক ১ শতাংশে, ওমানে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে, সৌদি আরবে ১ দশমিক ১ শতাংশে, সুইডেনে ১ শতাংশে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২ দশমিক ৫ শতাংশে, যুক্তরাজ্যে ১ দশমিক ৩ শতাংশে, যুক্তরাষ্ট্রে ২ দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বড় একটি কারণ ছিল অর্থনৈতিক মন্দা। ছাত্ররা পড়াশোনা শেষ করে অর্থনৈতিক মন্দায় কর্মসংস্থান করতে পারছিল না। জনগণ পণ্যমূল্য বাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করতে পারছিল না। এই দুই কারণে আন্দোলনে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। নতুন সরকারকে এখন বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এতে উৎপাদনও বেড়ে একদিকে পণ্যের জোগান বাড়বে, ফলে দাম কমবে। অন্যদিকে কর্মসংস্থান বাড়ায় মানুষের আয় বাড়বে, তখন মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা হলেও তাদের ওপর কম পড়বে।

বাজারে তথ্যের ঘাটতিও প্রকট। দেশের জনসংখ্যা কত হবে। বিদায়ি সরকার ১৭ কোটি ধরে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের হিসাব করত। বাস্তবে জনসংখ্যা আরও বেশি বলে অনেকে মনে করেন। বুধবার বিশ্ব জরিপ সংস্থা নামে একটি সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জনসংখ্যা এত বেশি হবে বলে অনেকে মনে করেন না। কিন্তু বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয় করতে হলে প্রকৃত জনসংখ্যার তথ্য থাকতে হবে। সেটি এখন কারও কাছেই নেই। এজন্য সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জাতিসংঘের মাধ্যমে দেশে জনসংখ্যার প্রকৃত চিত্র বের করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের জরিপ জরুরি।