অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বৈষম্যহীন নতুন সম্ভাবনার বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানিয়েছে আদিবাসী, প্রতিবন্ধী সমাজ প্রতিনিধি, যৌনকর্মী সমাজের অধিকার কর্মী, যুবক এবং নারী অধিকার কর্মী, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক, জলবায়ু কর্মী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, দলিত-হরিজন সম্প্রদায়সহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যরা।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে একশনএইড বাংলাদেশ-এর আয়োজিত সংলাপে এই আহ্বান জানানো হয়। সংলাপের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘সকলে মিলে সমতা’।
বক্তারা বলেন, “ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র সংস্কার ও পুনর্গঠনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনা ও পরিকল্পনায় অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন। নতুনভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের এই যাত্রায় বৈষম্যের শিকার তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দাবিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
জাতীয় উন্নয়নে নারীদের কার্যকরীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা, প্রতিবন্ধীবান্ধব সরকারি সেবাসহ কর্মক্ষেত্রের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি, দলিত-হরিজন ও যৌনকর্মীদের সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আদিবাসীদের অধিকার সুনিশ্চিত করাসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার মূল্যায়ন ও সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক, জেন্ডার সংবেদনশীল ও ন্যায্যতার সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়তে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করার মধ্য দিয়ে সংলাপ শুরু হয়। পরে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিরা তাদের জীবনের প্রতিবন্ধকতা ও রাষ্ট্র সংস্কারে নিজেদের আকাঙ্ক্ষর কথা প্রকাশ করেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক নিশীথা জামান নিহা বলেন, আমরা ছাত্র-জনতা একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলাম। আমরা যদিও অস্থায়ীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি কিন্তু এখ উদযাপন করতে পারছি না কারণ আমাদের দেশের বিভিন্ন খাতে এখনো বৈষম্য বিদ্যমান। সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এখনো অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন।”
আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি পুচাইনু মারমা বলেন, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। যদিও কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো তৈরি করা হয় কিন্তু সেখানে সেবা পাওয়া যায় না। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান না করলে আমরা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছি তা সমাধান হবে না।
প্রতিবন্ধী সমাজ প্রতিনিধি মেহেদী হাসান বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমাদের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি অর্থ সাহায্যের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন।
যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক নিলুফা বলেন, ‘আমরা যৌনকর্মীদের জন্য ন্যায়বিচার চাই। সম্প্রতি আমরা সহিংসতার শিকার হচ্ছি। আমরা নিরাপত্তা ও আইনের শাসন চাই। হামলাকারীদের বিচার চাই।’
যুব এবং নারী অধিকার কর্মী আবিদা সুলতানা আখি বলেন, ‘নারী সংবেদনশীল সরকারি সেবা প্রদানের প্রক্রিয়াকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। এখনো নারীদের ন্যায্যতার ভিত্তিতে সেবা প্রদানে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। আমরা একটা ন্যায়সঙ্গত সমাজ চাই।’
নারী কৃষক সমাজের প্রতিনিধি আনোয়ারা বেগম বলেন, নারী কৃষকদের নিজস্ব জমি নেই, এখনো মজুরিবৈষম্য রয়েছে, নিজস্ব ব্যবসার জন্য স্থানীয় বাজারে সুযোগ কম, সৌচাগার সুবিধা অপর্যাপ্ত ও স্থানীয় প্রশাসনিক কার্যালয় সম্পর্কে জানে না। আমরা একটি নারী কৃষিসুলভ বৈষম্যমুক্ত সমাজ চাই। আমি চাই সব নারী কৃষকের পরিচয় হিসাবে ‘কৃষক কার্ড’ থাকবে যাতে সেবা পেতে এবং সুবিধা পেতে পারে।
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আজমেরী হক বাঁধন বলেন, “আমি অভিভাবকত্ব এবং উত্তরাধিকার আইনে সংস্কার চাই যাতে বৈষম্য না থাকে। আইনগুলো যাতে বর্তমান সময়ের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আমি চাই সব পিতামাতা তাদের সন্তানদের শিক্ষা দিক যে, তারা কীভাবে নিজেদের অধিকার আদায় করতে পারে। কীভাবে অন্যদের অধিকার নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে।”
রাষ্ট্র সংস্কার ও পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জের সময় এই সংলাপের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে সংলাপের সঞ্চালক ও একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, “এখন পরিকল্পনার সময়। সরকার ও বিভিন্ন মহলে গঠনমূলক ভাবনা এবং পরিকল্পনা চলছে। এখনই আমরা যদি বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা না করি তাহলে আবারও কেউ বৈষম্যের শিকার হবে কি না, এই সংস্কার যাত্রায় আবারও কেউ উপেক্ষিত হবে কি না সে চিন্তা থেকেই এ ধরনের সংলাপের আয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু তৃণমূলদের দাবি ভুলে যাওয়া যাবে না। আমরা তরুণদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখছি।”
একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সোসাইটির চেয়ারপার্সন ইব্রাহিম খলিল আল জায়াদ বলেন, “আমরা এখন সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বৈষম্যের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো পুরোটা করে যেতে পারবে না, তাদের শুরু করে যেতে হবে। কিন্তু শুরুটা হতে হবে সঠিক। যাতে করে পরবর্তীতে এই ধারায় তরুণদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কারের সব কার্যক্রম বৈষম্যহীনভাবে চলতে পারে।”
সংলাপে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন একশনএইড বাংলাদেশ-এর হেড অব প্রোগ্রাম অ্যান্ড এনগেজমেন্ট কাজী মোরশেদ আলম। এছাড়াও নারী অধিকার কর্মী ডালিয়া ইসলাম, ট্রান্সজেন্ডার সমাজের প্রতিনিধি ইভান আহমেদ কথা, দলিত-হরিজন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি খিলন রবি দাশ, শিশু সমাজের প্রতিনিধি বিথি আক্তার, নারী অধিকার কর্মী জিনিয়া আফরিন স্মৃতি, তৈরি পোশাক-শিল্প কর্মী বিলকিস, জলবায়ু কর্মী সোহানুর রহমান ও একশনএইড বাংলাদেশের উইমেন রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইকুইটির ব্যবস্থাপক মরিয়ম নেছাসহ গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সংলাপ শেষে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে বিশেষ কার্টুন ও শিল্প-কর্ম প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন আমন্ত্রিত অতিথিরা।