ফিরে দেখা–করোনা কালের জীবন ধারা—১৪

// এবাদত আলী
আজকাল যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হলো ফেস বুক। আর লেখা শেষ করার পর অতি সহজেই ফেসবুকে আপলোড করলেই তা মুহূর্তেই পাঠকদের নাগালের মধ্যে চলে যায়। ফলে লেখক ও পাঠকের মাঝে মেলবন্ধন তৈরি হয়। করোনাকালের জীবন ধারা লিখতে গিয়ে অগণিত পাঠক ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের অনেক কথা আমার লেখুনির মাধ্যমে প্রচার করার অনুরোধ জানান। এই করোনার করুণ সময়ে অনেকে ত্রাণের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা তুলে ধরতে অনুরোধ করেন। সরকারি ত্রান সহায়তার তালিকা তৈরিতে কালক্ষেপন, মুখ চিনে চিনে তালিকা প্রনয়ন, অনলাইনের তালিকা প্রস্তুতকারিদের নামের পাশাপাশি নিজেদের মোবাইল নম্বর দিয়ে একাধিক নাম তালিকাভুক্ত করে কর্তৃপক্ষের নিকট জমাদান-ইত্যাদি ইত্যাদি। মধ্যবিত্ত পরিবার যে রাতারাতি নি¤œ বৃত্ত পরিবারে গণ্য হচ্ছে, যাদের দিকে ফিরে তাকাবার কেউ নেই এসব কথা।
সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তাগণ দফায় দফায় সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির অধীনে বেশ সুখের হালতে দিন গুজরান করছেন। মাস গেলে মাইনে তাদের ধরাই আছে। করোনাকালে তাদের পক্ষে যেমন লকডাউন মান্য করা অতি সহজ তেমনি দেশে প্রায় ১ লাখ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি -বেসরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারির জীবন কেমন কষ্টে কাটছে তার হিসাব রাখার লোকের সংখ্যা খুবই নগন্য। সকলেই হাল নিয়ে ব্যস্ত। বকেয়ার কথা আর কেইবা মনে রাখে? অবসর গ্রহণের সময় প্রাপ্ত লামগ্যান্ট, গ্র্যাচুইটির টাকা-পয়সা ব্যাঙ্ক একাউন্টে সজতনে জমা করে রাখলেও বর্তমান করেনাকালে অেেনকেরই তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তাই তাদের জন্য আর কিছু নাহোক রেশনিং ব্যবস্থা চালু করলে তারা শেষ বয়সে পরিবার পরিজন নিয়ে অন্তত দুমুঠো খেয়ে জীবনধারণ করতে পারতো। বলতে গেলে বর্তমানে তারাই সুবোধ বালকের মত করোনা আদেশের শতভাগ লকডাউন পালন করে চলেছে। মহামারি এই করোনকালে মহা সংকটে আছেন দেশের প্রায় সাড়ে ৯ হাজার নন এমপিও স্কুল কলেজ ও মাদরাসার ১ লাখ ১০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারি। যাদের মধ্যে সম্প্রতি দুই হাজার ৬ শ ১৫ প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্ত হওয়ায় ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারির বেতনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারি। করোনার ভয়ে আগামি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার কারণে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আয় নেই। বিধায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যে সন্মানি দেওয়া হতো তাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে ৫০ হাজার কিন্ডারগার্টেন বা কেজি স্কুলে প্রায় ৬ লাখ শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান বেশিরভাগই ভাড়া বাড়িতে চলে। আর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ্এইসব প্রতিষ্ঠান শতভাগ নির্ভরশীল। এইসব প্রতিষ্ঠানে নি¤œবৃত্ত ও নি¤œ মধ্যবৃত্তের সন্তানেরা লেখা-পড়া করে। তাদের স্কুল বন্ধের সময় কেই বেতন দিতে পারছেনা। আবার কেউ দিতেও চাচ্ছেনা। ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন শিক্ষকেরা। এরই মধ্যে কিন্ডারগার্টেনের দুটি সংগঠন পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের কাছে প্রনোদনা চেয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা হয়তো তাদের আবেদন মঞ্জুর করবেন। তা নাহলে ভয়াবহ করোনার তান্ডবে অনেক প্রতিষ্ঠনই চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। করোনার মধ্যে করুণ অবস্থায় দিনযাপন করছেন ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ি ৪ হাজার ৩শ ১২ টি ইবতেদায়ি মাদরাসাতে২১ হাজার শিক্ষকের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা অনেক বেশি। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৫ শ ১৯ টি মাদরাসার প্রধানশিক্ষকদের মাসিক ২৫শ টাকা এবং সহকারি শিক্ষকদের ২৩শ টাকা ভাতা দেয় সরকার। তবে চলতি অর্থ বছরে এসব প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ও বরাদ্দ থাকলেও কাজ শেষ করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। করোনাকালে তা আটকে আছে। ফলে শিক্ষকরা চরম কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে যে ১শ ৫ টি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় রয়েছে তার শিক্ষক সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। কর্মকর্তা-কর্মচারি মিলিয়ে এই সংখ্যা দ্বিগুনেরও বেশি। বড় বিশ^বিদ্যালয়গুলো নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করলেও সমস্যায় আছে ছোট ও মাঝারি বিশ^বিদ্যালয়গলো। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০ হাজার ৪শ ৫২ টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯ হাজার ৭শ ৫৯টিই বেসরকারি। করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশের ৬ হাজার ৮শ ৬৫ টি কওমি মাদরাসাকে ১০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ৭ হাজার কওমি মাদরাসায় ঈদের আগে আর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়। এছাড়া পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশের সকল মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের আথিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করবেন বলে জানা গেছে।
বিশ^ ব্যাপি করোনাভাইরসের কবলে পড়ে বহু বাঘা বাঘা দেশ আজ দিশেহারা। আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশও তা থেকে বাদ যায়নি। সারা বিশে^ আজ (এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ) ২১৩ টি দেশে অদৃশ্য শত্রু করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর কবলে মৃত্যুবরণ করেছে লাখ লাখ মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যা বেশুমার।
আমাদের এই প্রিয় দেশটি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবৃুর রহমানের আহবানে সাড়া দিয়ে সেসময় এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতার জন্য যার যার অবস্থান থেকে লড়াই সংগ্রাম করেছিলো। সেসময় এদেশিয় কিছু ধর্মান্ধ মৌলভি-মওলানা ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো। তাদের বিরোধিতা সত্তেও এদেশের দামাল ছেলেরা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার ও এদেশিয় দোসর রাজাকার আলবদর ও আল সামসদের বিরুদ্ধে একটানা ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীনতার সুর্য ছিনিয়ে এনেছিলো।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই করোনা যুদ্ধ মোকাবিলা করার জন্য শক্ত হাতে হাল ধরেছেন। এদেশর ১৭ কোটি মানুষকে তিনি এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। একমাত্র লকডাউন অমান্য করা ছাড়া তার আহবানে কম-বেশি সকলেই সাড়া জুগিয়েছেন। ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা আজ সকলেই বয়োবৃদ্ধ। বর্তমানে তাদের সংখ্যা অর্থাৎ দেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪শ ৬৭ জন। অদৃশ্য এই মহামারি করোনা যুদ্ধকালে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাদের এই মুহুর্তে লকডাউন পালন করা ছাড়া আর করার কিছুই নেই। এই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বর্তমানে ঘোর দুর্দিন বলতেই হয়। সরকার কর্তৃক তারা মাসিক সন্মানি ভাতা লাভ করে থাকেন। করোনাকালে তাদের মধ্যে অনেকের সংসারই অচল হয়ে পড়েছে। সরকার কর্তৃক তাদের জন্য বিশেষ প্রনোদনাসহ সেই সাথে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যতদিন অব্যাহত থাকবে সরকার জনসাধারণকে ততদিন মানবিক ত্রান সহায়তা দিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপানা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।
তিনি গত ৬ মে দুপুরে সাভারের রাজাশন এলাকায় সেন্ট পিটারার্স স্কুল ও অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অসহায় দুস্থ মানুষদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে একথা বলেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবার প্রতি আড়াই হাজার টাকা করে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য নগদ আর্থিক সহযেগিতা বরাদ্দ করেছেন। এই টাকা উপকার ভোগিদের মোবাইল একাউিন্টে পৌঁছে যাবে। ইতোমধেই ১ কোটি ৩৬ লাখ পরিববারকে মানবিক ত্রাণ সহযোগিতার আওতায় আনা হয়েছে যার মাধ্যমে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মহীন অসহায় ও দরিদ্র ৫ কোটি মানুষ সরাসরি সরকারের বিশেষ সুবিধা ভোগ করবে।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক অতি সম্প্রতি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা ও তথপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীবচ ওয়াজেদের পরামর্শে ডিজিটাল বাংলাদেশের সেবা দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তথ্যপযুক্তি বিভাগ নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রী গৃহীত বাস্তবমুখি পদক্ষেপের কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছে। তিনি আরো বলেন, ‘করোনা ডট গভ ডট বিডি’ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশের ৬০ লাখ নাগরিক ভিজিট করে সেবা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের ১ হাজার উদ্যোক্তা হটলাইনের মাধ্যমে সহায়তা প্রদানের জন্য সম্পৃক্ত রয়েছে। হটলাইনের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা চেেেয়ছে এমন প্রায় ৩০ হাজার পরিবারকে খদ্য পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য ৫০ লাখ নাগরিকের ডাটাবেউজের মাধ্যমে ডিজিটাল প্লাটফরম অডিটর ক্রাউন্ডিং ফর্ম তৈরি করা হচ্ছে। (সময়কাল: ১৮-০৫-২০২০) (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী
সদস্য, পাবনা প্রেসক্লাব, পাবনা।
তারিখ : ২৯/০৬/২০২৪