। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
১৯৭৩ সালের ৮ ই জুন পাবনা জেলখানা থেকে সাত জন বন্দীর পলায়ন এবং চার জন বন্দীর নিহত হওয়ার ঘটনা তৎকালীন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণ-মাধ্যমে আলোচিত সংবাদ হয়েছিল। ঘটনাটি নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। জেল থেকে বন্দী পলায়ন নিয়ে একাধিক বার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে পক্ষ-বিপক্ষে বিতর্ক হয়েছে। পাবনা জেলখানা স্থাপনের শতবর্ষেও এমন ঘটনা আর কখনো হয়নি।
জেলখানা থেকে বন্দী পলায়ন করার ঘটনা কালেভদ্রে দু’একটা ঘটলেও সাতজন বন্দী একসাথে পালিয়ে যাওয়ার এমন ঘটনা বিরল। জেলখানায় বন্দীকে হত্যা করার ঘটনাও এই উপমহাদেশে শতবর্ষের মধ্যে দুই একবার সংঘটিত হয়েছে। প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য ১৯৫০ সালে ২৪ শে এপ্রিল রাজশাহী জেলখানায় খাপড়া ওয়ার্ডে আটক ৪০ জন রাজনৈতিক বন্দীর উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে ৮ জন বন্দীকে হত্যা করেছিল। বাঁকী ৩২ জন বন্দী গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ আহতদের মধ্যে পাবনার দুইজন বন্দী ছিলেন। তাঁরা হলেন পাবনা’র কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড প্রসাদ রায় এবং ভাষা আন্দোলনে আটক ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ৩ রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ইতিহাসের এক জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। সেদিন সেনাবাহিনীর একদল পথভ্রষ্ঠ সদস্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক জাতীয় চার নেতা যথাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলী এবং এ, এইচ, এম কামারুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। যে ঘটনাটি ইতিহাসের পাতায় একটি জঘন্যতম ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত।
উপরোল্লিখিত ঘটনা দুটির মাঝে ১৯৭৩ সালে পাবনা জেলখানায় সংঘটিত ঘটনার ভিন্নতা থাকলেও এমন ঘটনা আর দ্বিতীয়টি নাই। জেলখানা থেকে একসাথে ৭ জন বন্দীর পালিয়ে যাওয়া এবং পরেরদিন এদের মধ্যে ৫ জনের পূনরায় আটক হওয়ার ঘটনা সিনেমার গল্পের মত। জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া ৫ জন বন্দী জনতার হাতে আটক হওয়ার পর ৪ জন হত্যার শিকার হন এবং ১ জন পুনরায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আজ থেকে ৫১ বছর পূর্বে সংঘটিত পাবনা জেলখানা থেকে বন্দী পালানোর এমন ঘটনা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হলেও বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে সেই ঘটনাটি অজানা।
১৯৭৩ সালে পাবনা জেলখানায় প্রায় দেড় হাজার বন্দী আটক ছিল। এরমধ্যে প্রায় নব্বই ভাগ বন্দী ছিল স্বাধীনতা বিরোধী। স্বাধীনতার পর দালাল আইনে আটকদের মধ্যে বেশির ভাগ বন্দী ছিল রাজাকার, আলবদর, বিহারি, পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য, পিচ কমিটির সদস্য, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের নেতা কর্মী এবং নক্সাল বাহিনীর সদস্যরা। এরমধ্যে বিভিন্ন অপরাধে ১৮/২০ জন মুক্তিযোদ্ধা আটক হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা বন্দীদের মধ্যে ১৪/১৫ জন জেলখানার এক নম্বর ওয়ার্ডে থাকতেন। এক নম্বর ওয়ার্ডটি ছিল সংরক্ষিত। জেলখানায় উক্ত ওয়ার্ডটি কিশোর ও বালক বন্দীদের জন্য নির্ধারিত। সে সময় বিশেষ পরিস্থিতির কারণে কিশোর ও বালকদের পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধা বন্দীদের রাখা হয়েছিল।
জেল থেকে পালানোর সময় এক নম্বর ওয়ার্ডে বন্দী ছিলেন ১১ জন। তাঁরা হলেন ঈশ্বরদীর আমিনুল ইসলাম চুনু সরদার, পাবনা শহরের দিলালপুর মহল্লার সাইদুল ইসলাম মুন্নু, বাবলু ( টেংকু) ও গোলাম সরওয়ার, নয়নামতির নুরুল ইসলাম নুরু, পৈলানপুরের আব্দুল লতিফ সেলিম, আবদুল্লাহ হেল কাফি, শেখর ও রফিকুল ইসলাম রফিক, রাধানগর এলাকার আজমত হোসেন বাদশা এবং নাজমুল হক স্বপন। উল্লেখ্য জেল থেকে পালানোর কয়েকদিন পূর্বে এক নম্বর ওয়ার্ডে থাকা তিন জন গুরুত্বপূর্ণ বন্দী যথাক্রমে পাকশীর কাজী সদরুল হক সুধা, পাবনা শহরের দক্ষিণ রাঘবপুর এলাকার আহমেদ করিম এবং লিয়াকত আলী মঞ্জু’র কারাদণ্ড হলে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁদের রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর করে।
১৯৭৩ সালের ৮ ই জুন রোজ শুক্রবার। সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যে জেল থেকে পালানোর ঘটনাটি সংঘটিত হয়। সে সময় ছিল বর্ষাকাল। একটানা ১৫/২০ দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রচন্ড বৃষ্টিপাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ঠিক এমনি একটি সময়ে জেল পলায়নের ঘটনাটি ঘটে। বলা যায় হঠাৎ করেই ১১ জন বন্দী সিদ্ধান্ত নেয় জেল থেকে পালিয়ে যাবার। আর এই কাজে প্রধান সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আব্দুস সাত্তার নামে জেলখানার এক পুলিশ। ঐ পুলিশের মাধ্যমে আগেই ভিতরে পৌঁছে যায় জানালার রড কাটার হ্যাকসো ব্লেড। পরিকল্পনা হয় বিছানার চাদর দিয়ে মালা বানিয়ে সুউচ্চ প্রাচীর ডিঙানোর সিড়ি বানানো হবে। পরিকল্পনা মোতাবেক সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়।
৮ ই জুন সন্ধ্যার পর জানালার মোটা রড হ্যাকসো ব্লেড দিয়ে কাটা হয়। সবচেয়ে লম্বা তিনজন আগে বের হয়। পাবনা জেলখানার উত্তর পূর্ব কোণায় দেয়ালের পাশে এসে একজনের কাঁধে উঠে আরেকজন এভাবে মোট তিনজনেই দেয়ালে উঠে পড়ে। এরপর চাদর দিয়ে বানানো মালার মাধ্যমে অপর পাড়ে নেমে পড়ে। সেলিম, শেখর, বাদশা, রফিক, স্বপন, বাবলু ও সরওয়ার এই সাতজন প্রাচীর ডিঙ্গানোর পরই জেল কর্তৃপক্ষ টের পেয়ে যায়। বেজে ওঠে জেলখানার পাগলা ঘন্টা। ভিতরে আটকা পড়ে চারজন। তাঁরা হলেন আমিনুল ইসলাম চুনু সরদার, সাইদুল ইসলাম মুন্নু, আবদুল্লাহ হেল কাফি এবং নুরুল ইসলাম নুরু।
জেলখানা থেকে বের হওয়া সাতজন দুই ভাগ হয়ে দ্রুত দু’দিকে চলে যায়। সরওয়ার এবং বাবলু শহরের দক্ষিণে এবং সেলিম, শেখর, বাদশা, রফিক এবং স্বপন এই পাঁচজন শহরের উত্তর দিকে পালাতে থাকে। ইতোমধ্যে জেলখানার পাগলা ঘন্টা এবং ডিসি অফিসের সাইরেন এর অবিরত শব্দে পুলিশ, রক্ষীবাহিনী সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গোটা জেলাব্যাপী তৎপর হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জেলখানার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তন্নতন্ন করে পলায়নকারী বন্দীদের খোঁজ করতে থাকে।
৯ ই জুন শনিবার দুপুরে আটঘরিয়া উপজেলার শ্রীকান্তপুর গ্রামে স্থানীয় জনতার হাতে আব্দুল লতিফ সেলিম, শেখর, বাদশা, রফিক এবং স্বপন ধরা পড়ে। স্থানীয় জনতা আটককৃত পাঁচজনকে ঐ অঞ্চলের এক প্রভাবশালী নেতার কাছে হস্তান্তর করে। এরপর তাঁদের পাবনা শহরের রাধানগর ইছামতি স্কুল পাড়ায় এক অজ্ঞাত স্থানে এনে আটক রাখা হয়। সন্ধ্যার পর আটক পাঁচজনকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে নির্মাণাধীন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ভিতর নেওয়া হয়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার সময় অস্বাভাবিক ও অলৌকিকভাবে আব্দুল লতিফ সেলিম আবার পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সেখানে বাঁকী চারজন বন্দী যথাক্রমে শেখর, বাদশা, রফিক এবং স্বপনকে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করা হয়। আব্দুল লতিফ সেলিম সেখান থেকে পালিয়ে পাবনা সদর থানা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আজ থেকে ৫১ বছর পূর্বে সংঘটিত পাবনা জেলখানা থেকে বন্দী পলায়ন এবং হত্যাকান্ডের অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শী এখনো বেঁচে আছে। বেঁচে আছে সেই ঘটনার সাথে জড়িত থাকা বন্দীরা। জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া শহরের দিলালপুর মহল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম সরওয়ার এবং পৈলানপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ সেলিম এখনো বেঁচে আছে।সেদিনের ঘটনার সাথে জড়িত পৈলানপুরের আবদুল্লাহ হেল কাফি বেঁচে আছেন এবং দীর্ঘদিন যাবত আমেরিকায় বসবাস করছেন।
লেখক – আমিরুল ইসলাম রাঙা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক।