ফেলে আসা দিন গুলো–৫৬

— এবাদত আলী —
পাবনা সদর উপজেলার টেবুনিয়ার কোদালিয়া সরদারপাড়ায় অবস্থিত ‘ চেতনায় ৫২-৭১ যুব সংঘের’ উদ্যোগে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা প্রদান করা হবে। উক্ত সংঘের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সংঘের পক্ষ থেকে এই প্রথমবারের মত পাবনা সদর উপজেলার মালিগাছা ইউনিয়নের ২০ জন এবং আটঘরিয়া উপজেলার চাঁদভা ইউনিয়নের ৪১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে বলে সংঘের সভাপতি এসএম সিরাজুল ইসলাম বাবু ও সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম মামুন জানালেন। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মালিগাছা ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার হিসাবে সেখানে যাবার জন্য আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো।
১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেসময় বাংলার দামাল ছেলেরা দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘ নয় মাস একটানা মুক্তিযুদ্ধের ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আরবদর, আল শামস ও পিস কমিটির সদস্যগণ ভারতীয় মিত্র বাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্ম সমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাই মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কোন মূল্যায়ন করা হয়না। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণের পরই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে আরম্ভ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাসিক সম্মানী ভাতা চালু, মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের জন্য সরকারি চাকুরিতে কোটা বরাদ্দ, মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন এবং প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোন সংস্থার পক্ষ থেকে তাদেরকে সংবর্ধনা প্রদানের ঘটনা খুবই বিরল। আর সেই দায়িত্ব পালনে ব্রতি ‘ চেতনায় ৫২-৭১ যুবসংঘ। তাই তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।
২৮ মার্চ-২০১১, সোমবার সংঘের নিজস্ব কার্যালয় প্রাঙ্গনে উক্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। টেবুনিয়া সিড গোডাউন থেকে যে সরু পাকা সড়ক উত্তর দিকে এঁকে-বেঁকে চলে গেছে সেই সড়ক ধরে সামান্য একটু এগুলেই কোদালিয়া গ্রাম। এই গ্রাম এবং পার্শ¦বর্তী আটঘরিয়া উপজেলার কয়েকটি গ্রামের যুবসমাজ ২০১০ সালের ২৬ মার্চ গঠন করেছিলেন ‘ চেতনায় ৫২-৭১ যুব সংঘ’ নামের একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এক কালের খরস্রোতা রতœাই নদীর দক্ষিন তীর ঘেঁষে একখন্ড পতিত জমিতে সামিয়ানা টাঙিয়ে বিশাল মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। এদিন সকাল ১১টায় নির্র্ধারিত সময়ে তথায় উপস্থিত হলাম। বিশাল আয়োজন। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পাবনা ৫ আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার গোলাম ফারুক প্রিন্স। বিশেষ অতিখি হিসাবে উপস্থিত হলেন পাবনা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ মোশারোফ হোসেন, আটঘরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যন মো: ইশারত আলী, আটঘরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা, পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হাসান শাহীন। এছাড়া আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে পাবনা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তসলিম হাসান সুমন, আটঘরিয়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম সোহেল, পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি জালাল উদ্দিন বিশ্বাস, মালিগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ আব্দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম, পাবনা জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি সরদার মিঠু আহমেদ, পাবনা জেলা ছাত্র লীগের সভাপতি খন্দকার আহমদ শরীফ ডাবলু এবং এলাকার যুব বৃদ্ধসহ সভাস্থলে উপস্থিত হলেন হাজারো মানুষ।
শুরুতেই গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর সংঘের পক্ষ থেকে প্রধান ও বিশেষ অতিথিসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। ‘ চেতনায় ৫২- ৭১ যুব সংঘের ’ ধর্মীয় সম্পাদক আরিফুল ইসলাম কর্তৃক পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও শহীদদের রূহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাতের পর সংঘের সভাপতি এসএম সিরাজুল ইসলাম বাবুর সভাপতিত্বে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সুচনা করা হয়। সংঘের সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম মামুনের স্বাগত বক্তব্যের পর সংঘের সদস্যগণ বক্তৃতা করেন। আরো বক্তব্য দেন আমন্ত্রিত ও বিশেষ অতিথি বৃন্দ। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য হতে স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আটঘরিয়া উপজেলা কমান্ডের কমান্ডার জহুরুল হক, মালিগাছা ইউনিয়ন কমান্ডের কমান্ডার মো: হারেজ আলী, চাঁদভা ইউনিয়নের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মটর শ্রমিক নেতা রফিকুল ইসলাম রফিক, মালিগাছা ইউনিয়নের ডেপুটি কমান্ডার সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবাদত আলী, মালিগাছা ইউনিয়ন কমান্ডের অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও এলজিইডির এডিশনাল চীফ ইঞ্জিনিয়ার মো: জাহাঙ্গীর আলম, চাঁদভা ইউনিয়ন কমান্ডের অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট সমাজসেবক একেএম কামরুল ইসলাম ফুটু এবং উক্ত সংঘের উপদেষ্টা আলহাজ আলাউদ্দিন আলাল।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স ‘চেতনায় ৫২-৭১ যুবসংঘের’ শিক্ষা ও পাঠক্রম সম্পাদক মো: আলী হোসাইনের সম্পাদনায় স্মরণিকা “ দীপ্ত চেতনা”র মোড়ক উন্মোচন করেন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ক্রেষ্ট প্রদান করেন। সেই সাথে চারটি মহাবিদ্যালয় ও ছয়টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘ ৫২’র ভাষা আন্দোলন ও ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ’ শীর্ষক রচনা প্রতিযোগীতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন। তিনি প্রধান অতিথির ভাষনে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। স্বাধীনতার ৪০ বছরের মাথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর সেই সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই তা সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পরই কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর আগের জোট সরকার শুধু রাজাকার, আলবদরদেরই পায়রবি করেছে। তাদেরকে পুনর্বাসিত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়েছিল যা বাংলার মানুষ ভুলে যায়নি। তিনি নতুন প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এক কাতারে শামিল হবার জন্যও তিনি আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ক্ষণিকের জন্য অনুষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও সার্বিকভাবে তা সফলতার দাবিদার বলে মনে হয়েছে। ব্যতিক্রমধর্মী এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে সেদিন আমি নিজেকে ধন্য মনে করেছিলাম। (লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ০১/০৬/২০২৪.