// — এবাদত আলী —
বাংলাদেশের খাদ্য তালিকায় খিচুড়ি একটি ভাত জাতীয় উৎকৃষ্ট মুখরোচক খাবার। এই খাবার শুধু বাংলাদেশেই নয় ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোতেও অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। প্রধানত চাল এবং মসুরের ডাল দিয়ে সাধারণ খিচুড়ি ভাত রান্না করা হয়। এছাড়া মুগ ডাল, বজরা ও অন্যান্য ডালের ব্যবহার ও লক্ষ্য করা যায়। অঞ্চল ও রুচি ভেদে বিভিন্ন নামে এর নামকরণ করা হয়। যেমন নরম খিচুড়ি, ভুনা খিচুড়ি, নিরামিষ খিচুড়ি, মাংস খিচুড়ি ইত্যাদি। খিচুড়ি একটি সহজ পাচ্য খাবার । তাই শিশুদেরকে প্রথম কঠিন খাবার হিসেবে নরম খিচুড়ি খাওয়ানো হয়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মানুষের নিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি খিচুড়িও খাদ্য তালিকায় অর্ন্তভুক্ত ছিলো।
গ্রীক দূত সেলুকাসের বিবরণী থেকে জানা যায় , তিনি উল্লেখ করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশে চালের সাথে ডাল মিশিয়ে রান্না করা খাবার খুবই জনপ্রিয় ছিলো। মরোক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা কিশরির কথা উল্লেখ করেছেন, যা চাল এবং মুগ ডাল দিয়ে প্রস্তুত করা হতো। ১৫ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘুরতে আসা রাশিয়ান পর্যটক আফনাসিই নিকতিন খিচুড়ির কথা তার লেখায় ঊল্লেখ করেছেন। মৌর্য যুগের চন্দ্র গুপ্তের শাসনামলে চাল-ডালের খিচুড়ির কথা চাণক্যের লেখায় উল্বেখ পাওয়া যায়। গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের লেখাতেও চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য্যরে রাজ্যসভার রান্না ঘরে খিচুড়ির কথা পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতকে এক ফরাসি পরিব্রাজক লিখেছেন, সেসময় প্রায় সব বাড়িতেই খিচুড়ির প্রচলন ছিলো।
স¤্রাট আকবরের মন্ত্রী ও ঐতিহাসিক আবুল ফজল রাজকীয় রান্না ঘরে বিভিন্ন ধরনের খিচুড়ি রান্নার কথা তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। মুঘল রান্নাঘরে জাহাঙ্গীরের প্রিয় বিশেষ ধরনের খিচুড়ি রান্না হতো। পেস্তা, কিসমিস ও বিভিন্ন মশলা দিয়ে সেই খিচুড়ি রান্না করা হতো । জাহাঙ্গীর যার নাম দিয়েছিলেন‘ লাজিজান’।
১৭০০ শ শতকের মাঝামঝি সময়ে পাবনা জেলার সুজানগর থানার দুলাই গ্রামের জমিদার আজিম চৌধুরী এবং একই থানার তাঁতিবন্দ গ্রামের জমিদার বিজয় গোবিন্দ বাবুর বাড়িতে যে খিচুড়ি রান্না হতো সেসময় তা ছিলো প্রতিযোগীতা মুলক। একবার তাঁতিবন্দের জমিদারআজিম চেীধুরীর জমিদারকে নেমন্তন্ন করেন। জমিদার ঠাট্টার ছলে তাকে বলেন তা বন্ধু আমাকে কি খাওয়াবেন। জমিদার বিজয় গোবিন্দ বলেন আপনি যা খেতে চাইবেন। তখন জমিদার আজিম চৌধুরী তার কাছে খিচুড়ি খেতে চান এবং শর্ত দেন যে সেই খিচুড়ি পাক করবেন তার নিজস্ব বাবুর্চি। তথাস্তু বলে জমিদার রাজি হয়ে যান। এর পরের ঘটনা বেশ চমকপ্রদ। আজিম চৌধুরীর বাবুর্চি খিচুড়ি পাকের জন্য মসলা পাতির একটি ফিরিস্তি দেন। কিন্তু এই বাংলা মুলুকে সেসব মসলা মেলা দুষ্কর। বিজয় বাবু তাই কলকাতাসহ ভারত ভুভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে লোক পাঠালেন ফর্দ অনুসারে মসলা-পাতি জোগাড়ে। দীর্ঘদিন ধরে অনেক খোজাখুজি করে অবশেষে মসলা-পাতির জোগাড় হলো। এবার রান্নার পালা। কথিত আছে যেদিন তাঁতিবন্দ জমিদার বাড়িতে খিচুড়ি রান্না করা হয় বাতাসে তার সুঘাণ সারা গ্রামে ছড়িয়ে যায়। গ্রামের লোকজন সেই ঘ্রাণ শুঁকতে জমিদার বাড়ির চতুর্পাশে^ জমায়েত হয়ে জটলা করতে থাকে। এদিকে নির্ধারিত সময়ে দুলাইয়ের জমিদার আজিম চৌধুরী হাতির পিঠে চড়ে নেমন্তন্ন খেতে আসেন। খাবার এক পর্যায়ে জমিদার রান্নার প্রশংসা করে বলেন খুব সুন্দর রান্না হয়েছে বন্ধু। খেয়েও আরাম পাচ্ছি। আবার কোন দিন যে আপনার এখানে এমন খিচুড়ি খাবার নেমন্তন্ন পাবো। তাঁিতবন্দের জমিদার নাকি কাঁচুমাচু করে বলেন আপনার দোহাই লাগে বন্ধু অন্য যে কোন খাবার খাওয়াবো তাও ভালো কিন্তু খিচুড়ি খাবার আব্দার রক্ষা করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তিনি হাসতে হাসতে বলেন বন্ধু আর একবার যদি আপনাকে নেমন্তন্ন করে খিচুড়ি রান্না করে খেতে দিই তাহলে আমার জমিদারিই শেষ হয়ে যাবে।
এবার জগা খিচড়ির কথায় আসা যাক। খিচুড়ি সম্পর্কে বিস্তর কথা হলেও জগা খিচুড়ি সম্পর্কে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়না। বাঙালির ঘরে খিচুড়ি নিয়ে নিরীক্ষা হয় প্রচুর। কখনো মাংস দিয়ে কখনো মাছ দিয়ে বা কখনো সবজি সহযোগে। বাঙালির তালিকায় রয়েছে মুগ ডালের খিচুড়ি. সবজি খিচুড়ি, মসুর ডালের খিচুড়ি,মাংসের ভিচুড়ি, ইলিশ মাছের খিচুড়ি, ভুনা খিচুড়ি ইত্যাদি। কিন্তু জগা খিচুড়ি কোথায়।
পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে ভক্তদেরকে নিত্যদিন খিচুড়ি পরিবেশন করা হয়। জগন্নাথ দেবের খিচুড়ি লোক মুখে সংক্ষেপে হয়েছে ‘জগাখিচুড়ি’। আর বাঙালির কথ্যরীতিতে তা তালগোল পাকানোর প্রতিশব্দ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
খিচুড়ি বা জগা খিচুড়ি নিয়ে শুধু তালগোলই পাকায় না। এদেশে খুনাখুনির মত ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর হতে জানা যায় ২০২১ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়িতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে তৈরি খিচুড়িকে কেন্দ্র করে ঝগড়ার জেরে ভগ্নিপতিকে কুপিূেয় হত্যার অভিযোগ ওঠে। খিচুড়িকে কেন্দ্র করে অসাভাবিক কিছু ঘটনা ঘটলেই তাকে হয়তো বা জগাখিচুড়ি বলা হয়ে থাকে।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মমতাজ বেগমের পথসভা উপলক্ষ্যে ভোটারদের জন্য মাংস খিচুড়ি রান্না করায় এক কর্মীকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রম্যমান আদালত। একই সাথে ৮শ প্যাকেট খিচুড়ি জব্দ করে শিশু পরিবারে পাঠানো হয়। অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিতব্য উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে খিচুড়ি রান্না করায় পাবনার ঈশ^রদী উপজেলার এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক কে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং ৭ পাতিল খিচুড়ি জব্দ করে তা এতিমখানায় পাঠানো হয়।
ইদানিংকালে খিচুড়ি নির্বাচনী প্রচার-প্রচারনার যাঁতাকলে পড়ে জগা খিচুড়িতে পরিনত হতে চলেছে। দৈনিক চাঁদনী বাজার পত্রিকায় গত ২১ মে, ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত আদম দীঘি (বগুড়া) প্রতিনিধির খবর হতে জানা যায়, ৭০ জন নারী-পুরুষ গ্রামের মধ্যে রান্না করছিলো খিচুড়ি। রান্না শেষ হলে আনন্দের সহিত খাবে তারা। কিন্তু হঠাৎ হাজির হয় বগুড়ার আদম দীঘি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফিরোজ হোসেন। এরপর রান্না করা খাবারের মধ্যে দেওয়া হয় আবর্জনা। এসি ল্যান্ড ফিরোজ হোসেনের নির্দেশে তার গাড়ির চালক হজরত আলী রান্না করা খিচুড়ির মধ্যে ছাগলের বিষ্ঠাসহ বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা ছিটিয়ে দিয়ে খাবার গুলো নষ্ট করে দেয়। সংবাদে আরো বলা হয় ঐ খিচুড়ি কোন প্রার্থীর পক্ষের নয়। গ্রামের লোকেরা ১ পোয়া করে চাল এবং ৫০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে তারা পিকনিকের আয়োজন করেছিল।’ অবস্থা দৃষ্টে মনে করা যায় এসি ল্যান্ড সাহেব খিচুড়িকে জগা-খিচুড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ২৫/০৫/২০২৪.