বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় নবী প্রেম

— এবাদত আলী —
বাঙালি জাতির ক্ষণজন্মা পুরুষ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতি ও বাংলা সাহিত্যের এক মহা সম্পদ। বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে তার শ্রেষ্ঠত্য অজেয়। তার ক্ষুরধার লেখনির মাঝে যেমন বিদ্রোহের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়েছে অনুরুপভাবে মহান সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামীনের প্রিয় হাবিব দোজাহানের বাদশাহ হজরত মোহাম্মদ (স.) এর প্রতি তার প্রগাঢ় ভক্তি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার নিগুঢ় তত্ব তার কবিতার মাঝে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের জন্য তিনি ছিলেন আশ্বীর্বাদ স্বরুপ।
তার লিখনীতে বিশ্ব মানবতার মুক্তিদুত করুণার মুর্তপ্রতীক হজরত মোহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে বর্ণনাতীত ভালোবাসা, প্রেম ও শ্রদ্ধাবোধের যে প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তা মহাকালের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে। তিনি তাঁর কবিতায় নবী (সা.) এর শুভাগমণকে উপলক্ষ্য করে লিখেছেন , তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে, মধু পূর্ণীমারি সেথা চাঁদ দোলে যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে। কুল মাখলুকে আজি ধ্বনি ওঠে কে এলো ওই, কালেমা শাহাদতের বাণী ঠোঁটে কে এলো ওই, খোদার জ্যোতি পেশানিতে ফোটে কে এলো ওই, আকাশ গ্রহ তারা পড়ে লুটে কে এলো ওই, পড়ে দরুদ ফেরেশতা, বেহেশতে সব দুয়ার খোলে।। বিদ্রেহিী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ৩৩ বছর বয়সে এই গজলটি রচনা করেন। ১৯৩২ সালে জুলফিকার নামক গীতি গ্রন্থে গজলটি গান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। তার কবিতায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনে সারা দুনিয়ায় যেন খুশির পয়গাম ছড়িয়ে পড়ে। তাই তিনি লিখেছেন ত্রি ভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়, আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়। ধুলির ধরা বেহেশতে আজ, জয় করিল দিলোরে লাজ, আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধুসর সাহারায়।।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হজরত মোহাম্মদ(সা.) এর নামের প্রশংসায় লিখেছেন নাম মোহাম্মদ বোল রে তোরা নাম মোহম্মদ বোল, যে নাম নিয়ে চাঁদ সেতারা আসমানে খায় দোল। পাতায় ফুলে যে নাম আঁকা, ত্রিভুবনে যে নাম মাখা, যে নাম নিয়ে হাসীন ঊষার রাঙ্গে রে কপোল। যে নাম বাজে মরু সাহারায়, যে নাম বাজে শ্রাবণ ধারায়, যে নাম চাহে কাবার মসজিদ- মা আমিনার কোল। আবার তাঁর লেখুনিতে প্রকাশ ঘটেছে মোহাম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে, নামে এতো মধু থাকে কে জানিতো আগে। ওই নামেরই মধু চাহি মন -ভ্রমরা বেড়্য়া গাহি, আমার ক্ষুধা-তৃঞ্চা নাহি , ঐ নামের অনুরাগে।…. নিত্য ও নাম য়্যা ইলাহী যেন হৃদে জাগে।। মহা নবী (সা.) এর আগমনকে ঘিরে তাঁর রচিত গজল সকল সময়ই হৃদয় ছুয়ে যায়। সাহারাতে ফুটলোরে ফুল রঙ্গীন গুলে লালা, সেই ফুলেরই খসবুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা। সে ফুল নিয়ে কাড়াকাড়ি চাঁদ- সুরুজ -গ্রহ -তারায়, ঝুঁকে পড়ে চুমে সে ফুল নীল গগন নিরালা, চাহে সে ফুল জীন ও ইনসান, হুর-পরী ফেরেশতায়, ফকির দরবেশ বাদশাহ চাহে পরতে গলে মালা। চেনে রশিক ভ্রমরা বুল বুল সেই ফুলের ঠিকানা, কেউ বলে হজরত মোহাম্মদ কেউ বা কমলীওয়ালা। কাজী নজরুল হজরতকে আরবের উদিত সুর্য বলে উল্লেখ করে তাঁর গুনগান গেয়েছেন। সুর্য যেমনি করে সমস্ত জগতকে আলো দেয় তেমনি রাসুল (সা.) সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে কল্যাণ ও রহমতের এক ঐশী আলো নিয়ে এসেছেন। কবির রচনায় তা ফুটে উঠেছে: জেগে ওঠ তুইরে ভোরের পাখী, নিশি প্রভাতের কবি। লোহিত সাগরে সিনান করিয়া ঊদিল আরব-রবি। তিনি আরো বলেছেন, নহে আরবের, নহে এশিয়ার, বিশে^ সে এক দিন, ধুলির ধরার জ্যোতিতে হলো গো বেহেশত জ্যোতিহীন। তিনি লিখেছেন, খোদারে আমরা করিগো সেজদা রুসুলে করি সালাম, ওঁরা ঊর্ধের, পবিত্র হয়ে নিই তাহাদের নাম। হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নামের মাহাত্ব নিয়ে লেখা তার কবিতা যা ইসলামী গজল হিসেবে খ্যাত যেমন ; মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুল বুলি তুই আগে, তাই কি রে তোর কন্ঠেরই গান এতই মধুর লাগে। ওরে গোলাপ নিরিবিলি নবীর কদম ছুঁয়েছিলি , তার কদমের খুশবু আজো তোর আতরে জাগে…..।
শিশু নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) প্রায়ই তাঁর ¯েœহময়ী মাতার নিকট তাঁর পিতা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। তাঁর মাতা মা আমিনা তাই তাকে সঙ্গে নিয়ে পিতা আব্দুল্লাহের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনার দারুণ নাবিয় নামক স্থানে নিয়ে যান। সেখান থেকে ফিরে আমার সময় পথি মধ্যে আবওয়া নামক স্থানে মা আমিনা ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালে হৃদয় বিদারক কাহিনী তুলে ধরে কবি নজরুল রচনা করেন, কিছু দুর আসি পথ মা আমিনা কয়, বুকে বড় ব্যথা ,আহমদ বুঝি হলো সময় তোরে একলাটি ফেলিয়া যাবার! চাঁদ আমার কাঁদিসনে তুই রহিলো যে রহমত খোদার।
কবি নজরুল নবী প্রেমে এতই মশগুল ছিলেন যে, তিনি ঁতাঁর রচনায় নিজেকে নবী করিম (সা.) এর কদমে সঁপে দিয়ে কবিতা লিখেছেন। বক্ষে আমার কাবার ছবি চোক্ষে মোহাম্মদ রাসুল। মোহাম্মদ মোস্তফা নামের (ওভাই ) গুণের রশি ধরি খোদার রাহে সঁপে দেওয়া ডুববেনা মোর তরী। আল্লাহকে যে পাইতে চায় হজরতকে ভালো বেসে, আরশ কুরসি লওহ কালাম না চাহিতেই পেয়েছে সে। রসুল নামের রশি ধরে যেতে হবে খোদার ঘরে। মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি মোহাম্মদ নাম জপ মালা। মোহাম্মদ নাম শিরে ধরি , মোহাম্মদ নাম গলায় পরি, মোহাম্মদ মোর অশ্রু-চোখের ব্যথার সাথি শান্তি শোকের। চাইনে বেহেশত যদি ও নাম জপ্তে সদা পাই নিরালা। তিনি নবী করিম (সা.) এর নিগুঢ় প্রেমে মগ্ন হয়ে আরো লিখেছেন, নবী মোর মোর পরশ মণি , নবী মোর সোনার খনি, নবী নাম জপে যে জন সেইতো দোজাহানের ধনী। নবী মোর নুরে খোদা, তার তরে সকল পয়দা, আদমের ক্বলবেতে তার নুরের রৌশনী।
মহা নবী (সা.) এর স্মরণে রচিত বাংলার জতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা যা নায়াত, গজল এবং গান হিসেবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এমনি বহু সংখ্যক কবিতা রয়েছে যা আজো মুসলিম হৃদয়ে নবী প্রেমের দোলা দেয়। তিনি লিখেছেন, আমি যদি আরব হতাম মদীনারই পথ, এই পথে মোর চলে যেতেন নুর-নবী হজরত। … মা ফাতেমা খেলতো এসে আমার ধুলি লয়ে, আমি পড়তাম তার পায়ে লুটিয়ে ফুলের রেণু হয়ে। হাসান হোসেন হেসে হেসে, নাচতো আমার বক্ষে এসে, চোক্ষে আমার বইতো নদী পেয়ে সে ন্যামত। কবি লিখেছেন, কাবার জিয়ারতে তুমি কে যাও মদীনায়, আমার সালাম পৌঁছে দিও নবিজীর রওজায়। হাজীদের ঐ যাত্রা পথে, দাঁড়িয়ে আছি সকাল হতে, কেঁদে বলি কেউ যদি মোর সালাম নিয়ে যায়। পঙ্গু আমি আরব সাগর লঙ্ঘি কেমন করে, তাই নিশি দিন কাবা যাওয়ার পথে থাকি পড়ে।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবেই সমধিক সুপরিচিত। কিন্তু তার কবিতা, তার গানে সকল জায়গাতেই তিনি রাসুল প্রেমের অনবদ্য এক দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। লক্ষ কোটি মুসলিম হৃদয়ে জাগিয়ে তুলেছেন রাসুল প্রেমের ভাবাদর্শ বাণী। আজো কবি নজরুলের রাসুল প্রেমের স্তুতি, তাঁর রচিত অনবদ্য অসংখ্য কবিতা আর গান সারা বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তার অন্তরের গহীনে লুকিয়ে থাকা নবী প্রেমের সেই কথাই যেন বার বার স্মরণে আসে, যেমন ইয়া মোহাম্মদ মোস্তফা নবী সাল্লে আলা, সাফায়াতের কান্ডারী মদীনা ওয়ালা, ইয়া মোহাম্মদ মোস্তফা নবী সাল্লে আলা। খোদারি খাছ নুরের তৈয়ারি যিনি, গায়েবের বাণী যার মুখে শুনি, দোসরা কোন মাবুদ নাই এক আল্লাহ। নবী জি আদম সফিরও বাবা, নবীজি আমার কাবার ও কাবা। নুর ও নবীর প্রেমে কাবা হইয়াছে কালা, ইয়া মোহাম্মদ মোস্তফা নবী সাল্লে আলা।…নুর নবীজির শানে আমার খোদা উতালা, আয় মোহাম্মদ মোস্তফা নবী সাল্লে আলা। ভাবিয়া কয় কাঙ্গাল নজরুলে, দয়াল ও নবীর দিদারও পাইলে আপনাতে মালা গেঁথে পরাইতাম মালা, ওরে আপন হাতে মালা গেঁথে পরাইতাম গলায়, ইয়া মোহাম্মদ মোস্তফা নবী সাল্লে আলা। ইয়া মোহাম্মদ মোস্তফা নবী সাল্লে আলা।। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী,সাংবাদিক ও কলামিস্ট,সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব , তারিখ: ২৪ /০৫/২০২৪.