// এবাদত আলী //
এই ধরাধামে পদার্পণ করার পুর্বে এবং পরে একমাত্র অবলম্বন হিসেবে সর্বপ্রথম আমি যাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে প্রাণভরে ঘ্রাণ নিয়েছিলাম তিনিই আমার গর্ভধারিণী মা। যিনি আমার মুখে বার বার মধুর চুম্বন এঁকে দিয়ে সদা সর্বদা বুকে পিঠে আগলে রাখতেন তিনি আমার স্নেহময়ী মা। যার পরশে আমার মন ও প্রাণের গতি সঞ্চারিত হতো –সুখে দুঃুখে আনন্দ বেদনায় যিনি আমার মুখপানে চেয়ে সকল দুঃখ তাপ ভুলে যেতেন তিনি আমার সর্ব দুখিনী মা। যার হাতের কোমল পরশে আমার দুচোখের পাতা উন্মোচিত হয় যাকে আমি নির্লিপ্ত নয়নে প্রাণভরে শুধুই চেয়ে চেয়ে দেখতাম যিনি আমাকে লালন করেন, নিঃস্বার্থভাবে পালন করেন, ক্ষুধা পেলে মুখে আহার তুলে দেন। তৃঞ্চা পেলে পানি। তখন আমার বাড়ন্ত কাল। আমি বাড়তে থাকি এবং প্রাণভরে দেখতে থাকি আমার মাকে আর এই জগতটাকে। সে সবইতো আমার মায়ের অবদান। আমার কচি মুখে আধো আধো বোল ফোটে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটি শব্দ উচ্চারিত হয় তা হলো ‘‘মা’’।
অতি শৈশবে আমি ছিলাম দারুণ অসহায়। এই অসহায়ত্ব দুরিকরণে আমার মায়ের আদর ছিলো, সোহাগ ছিলো অমলিন, অপরিসীম। আমার মা আমার আনন্দ, আমার উল্লাস, আমার উচ্ছ্বাস।
আমার অক্ষরজ্ঞানের হাতে খড়িতেও আমার মা। তিনি আমাকে শিক্ষা দেন বাংলা বর্ণমালা, আরবী হরফ সমূহ। বাবা-মায়ের ঔরসজাত সন্তান হিসেবে এই ধরাধামে আগমণের পর থেকেই নিজের মত করে বেড়ে উঠতে গিয়ে যার মমতা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে, জ্ঞান ও বুদ্ধি-বৃত্তির বিকাশে সহায়তা করে, ধৈর্যশীল, পরিশ্রমী, কষ্ট সহিঞ্চু ও উদ্যমী জীবন গড়তে উদ্বুদ্ধ করে তিনি আমার মা। যিনি অসত্যের নাগপাশ হতে নিজেকে মুক্ত রেখে ন্যায় ও সত্যের পথে চলার জন্য অহরহ প্রেরণা যুগিয়েছেন তিনি আমার মা। নীচ দুর্বল অক্ষমতা ও হীনমন্যতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে আমার মনে সবল ও মহৎ চিন্তা শক্তির যিনি উন্মেষ ঘটিয়েছেন তিনি আমার মা। আমার মা আমাকে ভালোবাসতে শেখায়। ত্যাগী হতে-শেখায়। উদার হতে শেখায়। জ্ঞান ও আপন বুদ্ধি বিবেচনায় যাবতীয় প্রতিকুলতা দুরভিত করে নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে যিনি পরামর্শ দেন তিনি আমার মা। আমার বাবা-মা আমাকে শেখান, দয়াময়, প্রেমময় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কথা। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি সকলের লালন কর্তা, সব কিছুরই পালন কর্তা। তাঁর প্রিয় হাবিব সরওয়ারে কায়েনাৎ হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস পূর্ণ ভক্তি শ্রদ্ধার কথা। একজন আশেকে রাছুল হবার কথা। এভাবেই আমি আমার মায়ের নিকট হতে ইসলাম ধর্মের কথা শিখি। আমার মা বলতেন, ধার্মিক ও জ্ঞানী ব্যক্তিরাই এই পৃথিবীর অলংকার। এর মধ্য দিয়ে আমার মা আমাকে ধার্মিক হতে শেখান। ধর্মপথে থেকে জ্ঞান সাধনার ভেতর দিয়ে মহত্ব জীবনে চলার জন্য আমাকে পরামর্শ দেন।
আমি যখন পরিণত বয়সে উপনীত হতে থাকি তখন আমার জন্মদাত্রি মায়ের মত আমার জন্মভুমির নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী সুগভীর আকর্ষণে আমাকে কাছে টানে, মন প্রাণ আকুল করে। আমার গ্রামের পাশ দিয়ে বহতা বাঙড় নদী ও তার বয়ে যাওয়া স্রোতের কলতান, সবুজ প্রান্তর, পাখির সুমধুর গান আমার মনপ্রাণ আকুল করে। কেননা আমার মা আমাকে স্বদেশপ্রীতি শেখান। জননী ও জন্মভুমির সাথে মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। মানুষ মায়ের মত জন্মভুমিকে ভালোবাসে।
আমার মনে পড়ে ১৯৭১ সালে এই জন্মভুমির উপর প্রচন্ড আঘাত আসে। পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনী এ দেশের নিরপরাধ ও নীরিহ মানুষের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে নির্বিচারে গণহত্যা চালাতে থাকে। সেসময় পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর হিসেবে এদেশের রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী তাদের সাথে যোগ দিয়ে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তোলে।
সেই আঘাত প্রতিহত করবার জন্য এবং এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলার দামাল ছেলেরা মায়ের সম্ভ্রম ও মাতৃভুমি রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি তখন আমার মাকে বলি ‘মা’ আমিও মুক্তি যুদ্ধে যাবো। আমার ‘মা’ আমাকে সহাস্য বদনে বিদায় দেন। দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য সেদিন মায়ের অনুমতি নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দীর্ঘ ৯ মাস একটানা যুদ্ধ শেষে দেশ হানাদার মুক্ত হলে এবছর বীরের বেশে আবার আমি আমার মায়ের কাছে ফিরে আসি।
আমার নিকট মায়ের গুরুত্ব কথা এমন যে, মা তার সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপন। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান পৃথিবীতে ভুমিষ্ঠ হয়। মায়ের রক্তে মাংসে সন্তান তিলে তিলে বড় হয়। নিজের মুখের গ্রাস মা তুলে দেন সন্তানের মুখে। সন্তান সুখি হলে মায়ের আনন্দ হয় সীমাহীন। সন্তানের সুখই যেন তার নিজের সুখ হয়ে যায়। আমার মাকে আমি এভাবেই দেখেছি। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, আদর, সোহাগ, ত্যাগ, মঙ্গল চিন্তা দিয়ে মা যেভাবে আমাকে বড় করে তুলেছিলেন সেই ঋণ আমার পক্ষে কোনদিনও শোধ করা সম্ভব নয়। আর আমাকে ঋণী করেই আমার স্নেহময়ী মা একদিন আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন পরপারে। বাংলা ২১ আষাঢ় ১৪০৪ মোতাবেক ১৯৯৭ সালের ০৫ জুলাই শনিবার আমার মা এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন বটে তিনি সদাসর্বদা রয়েছেন আমার অন্তরে।
আমি আমার মাকে নিয়ে একটি কবিতা রচনা করি ২০০২ সালের ০২ সেপ্টেম্বর তারিখে। কবিতার নাম
মনে পড়ে আমার মা‘কে
মনে পড়ে
মনে পড়ে আমার
স্নেহ ময়ী মা‘কে
যার কোলে মাথা রেখে
নিরাপদ নিশ্চিন্ত ঘুমে
কাটিয়েছি বহুকাল।
এ জীবন চলার পথে
মায়ের স্নেহের ভূবন
গাঁথা আছে এ হৃদয়ে
হিরন্ময় স্মৃতির বাঁকে বাঁকে।
যখন সাঁঝ নামে
তখন মনে পড়ে
মনে পড়ে আমার মা‘কে।
মাটির পিদিম জ্বেলে
রাত অবধি প্রতিক্ষার পালা
সরিষা বাঁটা
ইলিশ মাছের ঝোলে
মাখানো ভাত
আর একটু নাও বাবা
এক লোকমা
মুখে দিয়েই দেখো।
আমি হারিয়েছি
হারায়েছি চিরতরে
আমার স্নেহময়ী মাকে
তাই মনে পড়ে মনে পড়ে
আমার মা‘কে।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ১১/০৫/২০২৪.