করোনা কালের জীবন ধারা ০৬


— এবাদত আলী

তবে সকলকেই এক পাল্লায় ওজন করা বা পাইকারি হিসেবে দোষারোপ করা ঠিক হবেনা। করোনাভাইরাসের আক্রমণের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা ইতোমধ্যেই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। জরুরি সেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান, যানবাহন এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সকলকেই নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করতে সরকারি নির্দেশ জারি করা হয়েছে। রাস্তা-পথে চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত মানুষ-জনের চলাচল সম্পুর্ণভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এসকল বিষয় দেখভালের জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান ও সেনা বাহিনীকে কজে লাগানো হয়েছে। যেদিন বাংলাদেশে সেনা সদস্যদেরকে দেশের টহল জোরদার ও করোনাভাইরসে আক্রান্তদের পাশে দাড়ানোর জন্য আহবান জানানো হয়, তারপরদিন দেশের মানুষদের চলাচল অনেকটাই সিমিত হয়। কিন্তু যখন দেখা গেলো সেনা সদস্যরা অতীতে যে ভুমিকা পালন করেছে এখন তা আর করছেনা। ফলে ঘরবন্দিদের মধ্যে অনেকেই বাসা-বাড়ির অভ্যন্তরে না থেকে সাহসি ভুমিকায় রাস্তা-পথে চলাফেরা করছে। সেনাবাহিনীসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যগণ মানুষের সঙ্গে নমনীয় আচরণ করায় তাদেরকে থোড়াই কেয়ার করছে।
অথচ অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি অথাৎ ওয়ান ইলেভেনের সময় ফখরুদ্দিন সরকারের সেনা প্রধান মঈনুদ্দিনের আদেশে সেনা সদস্যরা অবাধে ছাত্র-শিক্ষকের গায়ে হাত তুলেছে। তারা সড়ক-মহাসড়কের পাশে অবস্থিত ক্ষুদে দোকানদারের দোকানপাট বুলড্রেজার দিয়ে গুড়িযে দিয়েছে। তারা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে পাকা ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে, মসজিদ ভেঙেছে, হাট-বাজারেরর অভ্যন্তরের দোকানিদের দোকান তছনছ করে মালামালসহ তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। তখন রাস্তা-পথে অবৈধ যানবাহন চলাচল করতে কোনমতেই সাহস পেতোনা। শুধু কি তাই বড় বড় চুল ওয়ালাদের চুল কেটে দিয়েছে। স্কুল-কলেজের আশেপাশে বিনা কারণে ঘোরা ফেরা করা যুবকদেরকে পিটিয়েছে।
কিন্তু আজ! আজ তাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনা। বর্তমান সরকার কোরনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ যুদ্ধে সৈনিকদের কাজ হলো লোকজনকে ঘরে রাখা। কিন্তু লোকজন তাদের কে থোড়াই কেয়ার করছে। কিন্তু কেন?
দেশে তো আইন আছে। সংক্রামক রোগ(প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মুল) আইন, ২০১৮ যা জাতীয় সংসদে পাশ করা আছে। তারই ২৫ (১) ধারায় উল্লেখ আছে ,“যদি কোন ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধিন কোন অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনুর্ধ ৩ মাস কারাদন্ডে, বা অনুর্ধ ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।” আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যে জরিমানা করছেনা তা নয়। তবে তার পরিমান মানবিক কারনে কম। হয়তো বা সেকারনেই লোকজন আইন অমান্য করে চলেছে।
সিঙ্গাপুরে আমার এক ভাতিজা বর্তমানে লকডাউন অবস্থায় কাকিবুকিট এ্যাভিনিউ এর চার তলা ভবনের একটি কক্ষে অবস্থান করছে। সেখানে যদি কেউ মাস্ক ব্যবহার না করে জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হয় তাহলে সেদেশের আইনে ১শ ডলার জরিমানা দিতে হয়, আর যদি লকডাউন ভঙ্গ করে তাহলে তাকে ৫শ ডলার জরিমানা দিতে হয়। অনেকসময় বিদেশি নাগরিকদের ভিসা ও বাতিল করা হয়।
প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে লকডাউন এলাকার জনগণকে ঘরে থাকার জন্য আহবান জানানো হলে তা অমান্য করার কারণে মানুষজনকে নাকে খত, কান ধরে উঠ-বস করা, নি ডাউন করাসহ লাঠির বাড়ি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এদশেও করোনা আক্রমণের প্রথম দিকে যশোরের জনৈক সহকারি কমিশনার (ভুমি) এক ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে মাস্ক না পরে রাস্তায় বের হবার অপরাধে তিন বৃদ্ধকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে নিজের মোবাইল ফোনে ছবি ধারণ করে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। তিনি অমানবিক আচরণ করেছেন মর্মে সারা দেশে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। অবশেষে তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়। আমরা বলছিনা যে, সেনা সদস্যরা অতীতের ন্যায় অমানবিক আচরণ করুক। আবার এটাও কাম্য নয় যে, তাদের কথায় কর্ণপাত না করে নবাবি হালতে লোকজন অবাধে রাস্তাপথে বিচরন করে করোনাভাইরাস বিস্তৃতিতে সহযোগিতা করুক।
করোনাভাইরাস থেকে পরিত্রান পেতে যেসকল বিধি বিধান মেনে চলার প্রয়োজন তারমধ্যে কোয়ারেন্টাইন বা সঙ্গনিরোধ সবচেয়ে জরুরি। আর এটা করতে গেলে লকডাউন মানতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের কতিপয় সাহসি মানুষ তা যেন কোনমতেই মানতে নারাজ। তাদের কাছে করোনাভাইরাস যেন নস্যিতুল্ল। করোনাভাইরাসের এমন ঝুঁকির দিনে লকডাউন সম্পর্কে দৈনিক ইনকিলাব লিখেছে, এযেন শুধু নামেই লকডাউন। অদ্ভুত লকডাউন শিরোনামে পত্রিকাটি লিখেছে, মহাসড়ক ও প্রধান সড়কে চলছে চেকপোষ্টের নামে ফটোসেশন। অথচ পাড়া-মহল্লায় অবাধে চলছে যানবাহন। পাইকারি বাজার কাঁচা বাজারসহ পাড়া-মহল্লায় সব ধরনের দোকান-পাট খোলা। গাদাগাদি করে মানুষজন বাজার করছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে করছে ঘুরাঘুরি। অন্যদিকে দেশের প্রায় ৮শ গার্মেন্টস খুলে দেওয়ায় লাখ লাখ শ্রমিক ভিড় ঠেলেই যাতায়াত করছে। গাজিপুর ও সাভারে বেতনের দাবিতে কয়েক হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক গতকাল রাস্তায় নেমে তান্ডব চালিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে পুলিশ টিয়ার সেল নিক্ষেপ করেছে। সব মিলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য দেশব্যাপি জারি করা লকডাউন এক অদ্ভুত চরিত্র লাভ করেছে। ( দৈনিক ইনকিলাব, ২৮ এপ্রিল-২০২০)
করোনভাইরাসের আক্রমণে এদেশের নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়াা মানুষজনকে নিজেদের জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে। যাদের পেটে ভাত নেই তাদের কাছে করোনার ভয় তুচ্ছ। তাদেরকে প্রতিনিয়তই রুটি-রুজির তালাশে ঘরের বাইরে যেতে হয়। তবে যেতেই যখন হবে তখন ভারতের কেরালা রাজ্যের মডেল অনুকরণীয় বটে। কেরালার আল্পুঝায় ছাতা মডেল বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। সেখানে লকডাউনের মধ্যে কেউ বাইরে গেলে সঙ্গে একটি ছাতা নিয়ে বের হচ্ছে। ফলে রোদ-বৃষ্টি থেকে যেমন রেহাই পাচ্ছে তেমনি সামাজিক বা শারিরিক দুরত্ব মাপার জন্য পৃথক কোন ব্যবস্থা করার প্রয়োজন পড়ছেনা। একটি ছাতা ফুটালেই তার দৈর্ঘ ও প্রস্থ সামজিক দুরত্ব বা শারিরিক দুরত্বের পরিমাপ সহজেই সফল লাভ করছে।
অবশ্য যেসকল গরিব মানুষ পেটের ভাত জোগাতেই হিমশিম তাদের যদি ছাতা না থাকে তাহলে তারা ছাতা পাবে কোথায়। তবে সরকার থেকে ত্রান সহায়তার পাশাপাশি ছাতা সরবরাহ করা হচ্ছে কিনা তা অবশ্য সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। অপর এক ব্যক্তিতো বিশেষ ধরণের একটি হুলওয়ালা পোষাক তৈরি করে তা গায়ে চড়িয়ে রাস্তা-পথে দিব্যি চলাফেরা করছে। শারিরিক দুরত্ব বজায় রাখতে কাউকে অনুরোধ উপরোধ করতে হচ্ছেনা। গায়ে হুলফুটার ভয়ে লোকজন তার থেকে দুরত্ব বজায় রেখেই চলাচফেরা করছে। (সময় কাল: ৩০-০৪-২০২০) (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ৩০/০৩/২০২৪