। | আমিরুল ইসলাম রাঙা |।
উনিশ শ’ একাত্তর সালের উত্তাল মার্চ। বাঙালির স্বাধীনতার মাস। মার্চ মাসের শুরু থেকে ২৬ শে মার্চ পর্যন্ত প্রতিটি দিন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অন্যান্য দিন । এই মাসেই শুরু হয় পাকিস্তান সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন। ২ রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। ৩ রা মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত হয় স্বাধীনতার ইশতেহার। এরপর ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান থেকে ঘোষণা হয় বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শুরু হয় বাঙালির স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ শে মার্চ পতাকা উত্তোলন কর্মসূচী ঘোষণা করে।
১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন। উভয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠা অর্জন করে। ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে। ১ লা মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিয়ে জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনিদিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এমন ঘোষণায় গোটা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ সারাদেশে লাগাতার হরতালের ডাক দেয়। ১ লা মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ২ রা মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ডাকসু’র ভিপি আসম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ৩ রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ঢাকা পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। ডাকসু’র ভিপি আসম আব্দুর রব, জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন, ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এবং সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন করা হয়। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। উক্ত সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। দেশের নাম বাংলাদেশ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা – আমি তোমায় ভালবাসি।
৭ ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে পরোক্ষ ভাবে স্বাধীনতার ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, হুকুম দিবার জন্য আমি যদি না থাকি আমার সহকর্মীরা যদি না থাকেন, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে। আমরা তাদের ভাতে মারবো – পানিতে মারবো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিবো, তবুও বাঙালিকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।
৮ ই মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে দেশব্যাপী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ পাড়া মহল্লায় তরুণ, যুবকদের সংগঠিত করা হয়। স্কাউট, আনসার ও সাবেক সেনা সদস্যদের তত্বাবধনে ডামি রাইফেল এবং লাঠি-সোটা দিয়ে তরুণ যুবকদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়। এছাড়া প্রতিদিন দেশব্যাপী মিটিং মিছিল অব্যাহত থাকে। মিটিং মিছিলে শ্লোগান উঠে – বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো – বাংলাদেশ স্বাধীন করো। আমার দেশ তোমার দেশ – বাংলাদেশ বাংলাদেশ। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া সর্বত্র ছিল একই অবস্থা।
পাবনায় ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্রলীগের উদ্যোগে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১২ ই মার্চ থেকে পাবনা জেলা স্কুল মাঠে তরুণ যুবকদের সামরিক ট্রেনিং শুরু হয়। পরবর্তীতে সাহারা ক্লাবের উদ্যোগে জিসিআই স্কুল মাঠ, নয়নামতি অভিযান ক্লাবের উদ্যোগে চাঁদমারী মাঠ এবং রাধানগরে অধিনায়ক ক্লাবের উদ্যোগে মক্তব পুকুর পাড়ে ট্রেনিং করানো হয়।
২৩ শে মার্চ ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। এদিন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশব্যাপী স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন কর্মসূচী ঘোষণা করে। সেই কর্মসূচী পাবনাতে সফল করার লক্ষ্যে ব্যাপক আয়োজন করা হয়। ঐদিন সকাল ১০ টায় পাবনা টাউন হল মাঠে ছাত্র সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়।
ঢাকায় ৩ রা মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা মোহাম্মদ ইকবাল পতাকার নক্সা পাবনা নিয়ে আসেন। অতঃপর মোহাম্মদ ইকবালের ছোট ভাই মোহাম্মদ ইসমত এবং ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক আবুল কাশেম উজ্জ্বলের উপর পতাকা তৈরী করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা দু’জন পাবনার নতুন গলির মধ্যে ফিরোজ কমিশনারের ছোট ভাই লালুর দোকান থেকে দুটি পতাকা তৈরী করেন। লাল সবুজের মাঝে মানচিত্র খচিত সেই পতাকাটি পাবনা টাউন হল মাঠে উত্তোলন করা হয়।
২৩ শে মার্চ সকাল ১০ টায় শহর থেকে একটি বিশাল মিছিল এডওয়ার্ড কলেজে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী জমায়েত হয়। এরপর এডওয়ার্ড কলেজ থেকে পুনরায় মিছিল নিয়ে পাবনা টাউন হল মাঠে আসে। এছাড়া তৎকালীন ইসলামীয়া কলেজ ( শহীদ বুলবুল কলেজ), পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাড়া-মহল্লা থেকে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী পাবনা টাউন হল মাঠে উপস্থিত হন। সেখানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আব্দুস সাত্তার লালু, রফিকুল ইসলাম বকুল, সাহাবুদ্দিন চুপপু, মোহাম্মদ ইকবাল, বেবী ইসলাম, জহুরুল ইসলাম বিশু, রবিউল ইসলাম রবি, শিরিন বানু মিতিল, মোহাম্মদ ইসমত, গোলাম সরওয়ার সাধন, ফজলুল হক মন্টু, অখিল রঞ্জন বসাক ভানু, খন্দকার আওয়াল কবীর, আব্দুল কাদের, আব্দুর রহিম পাকন, রেজাউর রহিম লাল, ইশারত আলী জিন্নাহ, আবুল কাশেম উজ্জ্বল সহ আরো অনেকে। সেখানে ছাত্র নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শেষে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলা হয়।
অতঃপর স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রদর্শন করে আনুষ্ঠানিক ভাবে টাউন হলের ছাদে উত্তোলন করা হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বকুল পতাকা উত্তোলন করেন। পরে সেখান থেকে মিছিল নিয়ে পাবনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জজকোর্ট ভবন, পাবনা জেলা স্কুল সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এছাড়া ঐদিন বিকালে পাবনা পুলিশ লাইন মাঠে সেচ্ছাসেবক বাহিনীর এক সমাবেশে আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন করেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সাত্তার লালু।
২৩ শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের পর ২৪ এবং ২৫ শে মার্চ পাবনা শহরের বিভিন্ন অফিস আদালত এবং বাড়িঘরে লাল সবুজের মাঝে মানচিত্র খচিত পতাকা উড়তে দেখা যায়। পরবর্তীতে ২৮ শে মার্চ পাবনায় প্রতিরোধ যুদ্ধে হানাদার মুক্ত হলে ১০ ই এপ্রিল পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানো হয়।
উল্লেখ্য স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ২ রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলিত পতাকা এবং ৩ রা মার্চ ঢাকা পল্টন ময়দানে ঘোষিত ইশতেহার ১৯৭১ সালে ১০ ই এপ্রিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকার অনুমোদন করেন। এই প্রসঙ্গে আরেকটি তথ্য এই প্রজন্মের মানুষের জানা দরকার তাহলো মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ব্যবহৃত বাংলাদেশের পতাকা ২ রা মার্চ ঢাকায় এবং ২৩ শে মার্চ পাবনা সহ সারাদেশে উত্তোলন করা হলেও পতাকাটি তৈরী করা হয়েছিল ১৯৭০ সালের ৬ ই জুন। পরেরদিন ৭ ই জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দিয়েছিলেন বিএলএফ ( বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) এবং জয় বাংলা বাহিনী।
লেখক – আমিরুল ইসলাম রাঙা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ