যে ভাষণ এনে দিয়েছিল স্বাধীনতা


।। রফিকুল ইসলাম সুইট।।

রক্তঝরা একাত্তর! ৭ মার্চ! ফাগুনের আগুন রাঙা বিকেল! রেসকোর্স ময়দান! জনসমূদ্র! শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি/ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাঙালির প্রবাদপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে জাতিকে শুনিয়েছিলেন অমর কবিতাখানি। এই কবিতাই (ভাষণ) এনেদিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা।
সময়ের পরিক্রমায় আজ বৃহস্পতিবার সেই ঐতিহাসিক দিন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি ঐতিহাসিক দিন।
সেই ৫২ বছর আগের কথা। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ মানুষের মহাসমাবেশে পাক হানাদার বাহিনীর আসন্ন হামলা প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু তার মাত্র ২০ মিনিটের ভাষণে বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ বঙ্গবন্ধুর এ তেজদীপ্ত মুক্তির বাণী শোনার জন্য ওইদিন সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দলে দলে হেঁটে, বাসে-ট্রাকে-লঞ্চে-ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে নারী-পুরুষের স্রোতে সয়লাব হয়ে যায় তখনকার ঘোড়দৌড়ের এই বিশাল ময়দান।
বিকাল সোয়া ৩টায় পাজামা-পাঞ্জাবি-মুজিবকোট পরিহিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভামঞ্চে আসেন। জনতা তুমুল করতালি ও আকাশ কাঁপানো করতালির মাধ্যমে তাদের প্রিয় নেতাকে অভিনন্দন জানায়। বঙ্গবন্ধুও মঞ্চ থেকে হাত নেড়ে জনতার সমুদ্রকে অভিনন্দন জানান। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের রূপরেখা জনতার সামনে তুলে ধরেন। ঘোষণা করেন বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো লাখ লাখ বাঙালি শোনেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল¬াহ।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাঝেই শোনা যায় জনসমুদ্রের গর্জন, আনন্দধ্বনি। জনতার কণ্ঠে ‘জাগো জাগো-বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেস্নাগানে সেস্নাগানে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল তখন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। তার সেই বজ্রনির্ঘোষ আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিকামী জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মূলত রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই তেজদ্দীপ্ত ভাষণই ছিল ৯ মাসব্যাপী বাংলার মুক্তি সংগ্রামের মূল ভিত্তি।
বিশ্ব রাজনৈতিক বিশে¬ষকদের মতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ওই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্র কঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এই ঐতিহাসিক ভাষণ। যার আবেদন আজও অটুট রয়েছে।
৫২ বছরে অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলানো যায়নি শুধু ২০ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি। বিশ্বে এই একটি মাত্র ভাষণ যা যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেজে চলেছে- কিন্তু ভাষণটির আবেদন আজো এতটুকু কমেনি। বরং যখনই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ঐতিহাসিক ভাষণটি শ্রবণ করেন, তখনই তাদের মানসপটে ভেসে ওঠে স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা আন্দোলন-সংগ্রামের মুহূর্তগুলো, আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের আদর্শে।
দিবসটি উপলক্ষে পাবনা জেলা প্রশাসন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা জেলা পরিষদ, পাবনা পুলিশ প্রশাসন, পাবনা পৌরসভা, পাবনা জেলা আওয়ামীলীগ, পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ, হাজী জসীম উদ্দীন কলেজ, শহীদ এম মনসুর আলী কলেজ, সকল উপজেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন নানা কর্মসচী গ্রহন করেছে। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে সকাল ৯ টায় জেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ, সাড়ে ৯ টায় শিল্পকলায় আলোচনা সভা এবং সাড়ে ১০ টায় চলচিত্র , আলোকচিত্র ও বঙ্গবন্ধুর উপর ডকুমেন্টরি প্রদর্শণ।