‘এটাই বুঝি সঠিক পথ’

— আলাউদ্দিন আহমেদ —
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার দুর্নীতি-মজুতদারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন অনেকবার। কিন্তু তাতে দুর্নীতিবাজরা দমেনি। দীর্ঘ সময় পর বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও একইভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বারবার সতর্ক করতে হচ্ছে এবং জিরো-টলারেন্স নীতিতে এই অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে ঘোষনাও দিয়েছেন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে কঠোর হাতে দুর্নীতি দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন দলটির সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরাও পর্যায়ক্রমে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা) দেখানোর কথা বলছেন। এসব কি শুধু কথার কথা, নাকি দুর্নীতি দমনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে-এমন প্রশ্ন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মনে নাড়া দিচ্ছে।

সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় একাধিকবার মনোনীত প্রার্থীদের হলফনামায় উল্লেখিত অসম্ভব সম্পদ বৃদ্ধির যে বর্নণা পত্র-পত্রিকায় লাখো মানুষ দেখেছে, বাস্তবে তার থেকে অনেক গুন বেশি সম্পদের মালিক তারা। তখন দুদক বলেছিল, ‘নির্বাচনের পর হলফনামা ধরে অনুসন্ধান করা হবে’। কিন্তু সেই বক্তব্যের বাস্তবতা এখনও চোখে পড়ছেনা।

দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি প্রতিরোধে চোখে পড়ার মতো নতুন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দুদক, যা দেখে মানুষ মনে করতে পারে-‘এবার দুর্নীতিবাজদের খবর আছে’। আবার নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের দাখিল করা হলফনামায় অস্বাভাবিক সম্পদ বাড়ার খবর গণমাধ্যমে আলোচিত হলে দুদকের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, সময় করে খোঁজখবর নেওয়া হবে। কিন্তু সেই ‘খোঁজখবর’ নেওয়ারও সময় হয়নি সংস্থাটির। অনেকের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি এবং সম্পদের বিশ্বাসযোগ্য উৎস না থাকলেও সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ে এখনো কোনো টিম গঠন করা হয়নি।
সরকারের হাতে আছে সকল ধরনের আইন-শৃংখলা বাহিনী, সকল প্রশাসন। দেশের জনগনের স্বার্থ বিরোধী ব্যক্তিগত ধান্দাবাজির হোতা ‘দুর্নীতিবাজ’দের সংখ্যা অনেক নয়; তাই সদিচ্ছা থাকলে এসব দুর্নীতিবাজদের রোধ করা কঠিন কিছু নয়। মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশেই এর উদাহরণ আছে।
অর্জিত অবৈধ সম্পদ, বিদেশে পাচার করা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনকল্যাণে কাজে লাগালে নিশ্চয় সরকারের প্রতি জনগনের ইতিবাচক মনোভাব এবং আস্থা বাড়বে। চতুর্থবারের ক্ষমতায় আসীন আওয়ামীলীগ সরকারের কাছে এটা সকলের প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক। প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন সংস্থার জনবল বাড়িয়ে তাদের কাজের গতি বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। নির্বাচন হয়ে গেছে। নতুন মনোবল নিয়ে সরকার এগিয়ে যাবে, এটা ভাবছে সাধারন মানুষ। শেকড় পর্যায়ের খবর নিলে যে কেউ জানতে পারবেন এসব। এরজন্য বড় বড় সংস্থার অনুসন্ধান প্রয়োজন হবেনা।
আমরা সংবাদপত্রে দেখলাম, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৫ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি এবং জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা পেয়েই মন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের কঠোরতা ও জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের কাছে কয়েকজন মন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের এই মনোভাব তুলে ধরেছেন। কিন্তু বলা আর বাস্তবে প্রয়োগ করার মধ্যে পার্থক্য আছে।

নির্বাচনের ইশতেহার অনুযায়ী আওয়ামীলীগের অঙ্গিকার আছে দুর্নীতি দমন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশ ও মানুষের কল্যাণে এবার কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমনই সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হওয়া উচিত। শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ভাবনার বিষয় হচ্ছে; লাগামছাড়া দুর্নীতির প্রভাব পড়ছে সমাজজীবনে। অসৎরা উঁচু গলায় কথা বলছে। গুরুত্বপুর্ণ সামাজিক চেয়ারগুলোতে ওই মনোভাবের নেতৃত্ব থাকায় বাস্তবে সুষ্ঠুধারার কোন পরিবেশ তৈরি হচ্ছেনা। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড থেকে সরে যাচ্ছে তরুণ সমাজ। আশপাশের অসৎ আয়ের চাকচিক্য দেখে তারা ভাবছে, ‘এটাই বুঝি সঠিক পথ’। তাদের ভিতরের ভাল গুনাবলী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অসততার কাছে তারা আত্মসমর্পন করে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে। প্রতিবাদ না, আপস করে ভাগাভাগিতে অংশ নেয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। এখানেই বড় সংকট। বিবেক-মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। জাতি হিসেবে আমাদের বলিষ্ঠতায় ঘাটতি পড়ছে।
বহু আন্দোলন-সংগ্রামের বিজয়ী জাতি আমরা। অনেক রক্ত দেয়ার ইতিহাস রয়েছে আমাদের। সেই অমর শহীদদের রক্তঋণ শোধ করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সর্বক্ষেত্র থেকে দুর্নীতি-অব্যবস্থা দুর করে প্রয়োজন। নতুন সরকার যে ঘোষনা দিয়েছে তা বাস্তবে মানুষ দেখতে পাবে সেই প্রত্যাশা সকলের। ( লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, সাবেক সভাপতি-ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব)।