// এবাদত আলী
নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে নৌকা একটি অত্যাবশ্যকীয় মাধ্যম হিসাবে একসময় পরিচিত ছিলো। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে একস্থান হতে আরেকস্থানে যাতায়াত এবং মালামাল পরিবহনে নৌকার কদর ছিলো সর্বত্র। প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত কর্তৃক গঙ্গা বা পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদী শুকিয়ে গেলেও এখনো নদী পথে নৌকার ব্যবহার চালু আছে। দুনিয়া সৃষ্টির আদি থেকেই নৌকার প্রচল ছিলো বলে জানা যায়।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক প্রেরিত পয়গাম্বর হযরত নূহ (আ.)এর নৌকা বা কিস্তি মহা প্লাবনের পর জুদি পাহাড়ের পাদদেশে অবতরন করেছিলো বলে পবিত্র কোরআন শরীফে উল্লেখ রয়েছে।
নৌকার আভিধানিক অর্থ হলো; নাও, তরণী, জলযান, পোত, তরি ইত্যাদি। দাবা খেলার গুটি বিশেষকেও নৌকা বা কিস্তি বলা হয়ে থাকে। নৌকার সঙ্গে যাদের জীবন ও জীবিকা অর্থাৎ নৌকা বাওয়া যাদের জীবিকা তাদেরকে বলা হয় মাঝি এবং মাল্লা। খেয়া পারাপারে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে বলা হয় পাটুনি বা পাটনি। যে পথে নৌকা চলাচল করে তাকে বলা হয় নৌপথ, জলপথ বা নদীপথ। যে, নৌকায় যাত্রা করে তাকে নৌযাত্রি এবং নৌকায় আরোহনকারিকে নৌ আরোহি বলা হয়। নৌকায় চড়ে বেড়ানোকে অনেক সময় নৌকা বিলাস নৌবিহার বা নৌ লীলাও বলা হয়ে থাকে। হিন্দু পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে ও পদাবলিতে শ্রীকৃষ্ণের ও গোপিগণসহ নৌকায় লীলার বিবরণ উল্লেখ রয়েছে।
আগেকার দিনে রাজা-মহারাজা, বাদশাহ-সুলতান, উজির-নাজির,আমির, উমরা, জমিদার, বরকন্দাজ, কতোয়াল, লাঠিয়াল, আমলা ফয়লাসহ তীরন্দাজগণও নৌকাতেই ভ্রমণ করতেন। এইতো ক’বছর আগেও গ্রামাঞ্চলের লোকেরা বর্ষকালের পুরোটা সময় ধরে এবাড়ি ওবাড়ি এপাড়া ওপাড়ায় যাতায়াত করতে নৌকাকেই একমাত্র মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতো।
বারো আওলিয়ার এই দেশে সুদুর আরব ভুমি হতে যেসকল ওলি-দরবেশ ও বুজর্গব্যক্তি ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য এই অঞ্চলে আগমণ করেছেন তাঁরা বেশিরভাগই নৌপথে এসেছিলেন। মহান ওলিয়ে কামেল হযরত শাহ কারামত আলী জৈনপুরী (র.) নৌপথে এদেশে এসেছিলেন। তাঁর নৌকাতে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য একটি মক্তব চালু ছিল বলে জানা যায়। এখনো মোজাদ্দেদিয়া তরিকার পীর মাশায়েখের দরবারে গজল হিসাবে পরিবেশিত হয় ‘ মোজাদ্দেদিয়া তরিকায় দয়াল বাবার নৌকায় কে কে যাবি তোরা আয়রে আয়।’ বুজর্গ ওলি শাহ মাখদুম শাহ দৌলা (র.) নৌপথে বৃহত্তর পাবনা জেলার শাহজাদপুরের সন্নিকটে নৌবহর নিয়ে সর্বপ্রথম পোতাজিয়াতে আগমণ করেছিলেন। সেই থেকে উক্ত গ্রামের নাম হয় পোতাজিয়া। এমনি বহুবিধ ঘটনা প্রচলিত রয়েছে।
বারোভুঁইয়ার ইশাখাঁন তাঁর নৌবহর নিয়ে পাবনা শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সেসময়ের প্রবল খর¯্রােতা ইছামতি নদী পথে ঢাকা গমণ করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
বাংলাদেশে বহু ধরনের নৌকা রয়েছে। অঞ্চলভেদে নৌকাকে ডোঙা, ডিঙি, কুসা, বজরা, পিনাস বা পানসি এবং সাম্পান বলা হয়। খেয়া পারাপারের জন্য ব্যবহৃত নৌকাকে গুদারা নৌকা বলা হয়ে থাকে। বাইচের জন্য এক ধরণের নৌকা যা শুধু বর্ষা মৌসুমে বাইচের কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই নৌকার সামনের গলুইয়ের পাশে থাকে ডংকা। ডংকার বাদ্যে এবং বয়াতির জারি-সারি, বৈঠ্কিরি ও জাগ গানের তালে তালে নৌকার মাল্লাগণ খুব জোশের সাথে নৌকা বেয়ে থাকে।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আগমণের পর নৌপথেই বেশিসময় ভ্রমণ করতেন। তিনি নৌপথে শাহজাদপুর কাছারিবাড়ি এবং নওগাঁর পতিসরে পিনাস বা পানসি নৌকাতেই যাতায়াত করতেন। ১৯০২ সালের অগ্রহায়ণ মাসে কবিপতিœ মৃনালিনী দেবী কলকাতায় মৃত্যুবরণ করার পর কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে ফিরে এসে কবি ‘পদ্মাবোট’ নামে একটি তরীতেই নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছেন বলে জানা যায়। সোনার তরি নামক একখানা অনবদ্য কাব্যগ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। তাঁর গানে নৌকার কথা উল্লেখ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, খর বায়ূ বয় বেগে,চারিদিক ছায় বেগে নাওখানি বাইও…।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায় তরী ও মাঝি-মাল্লার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর গানে তরির কথা উল্লেখ রয়েছে। তিনি গেয়েছেন ‘ কোন কুলে আজ ভিড়লো তরি একোন সোনার গাঁয়- আমার ভাটির তরি আজি কেন —উজান যেতে চায়। এছাড়া ওগো নাইয়া ধীরে চালাও তরনি—গানও উল্লেখযোগ্য।
লোক গানেও নৌকা বা তরীর কথা উল্লেখ দেখা যায়। নাইয়ারে কোন দুরে যাও বাইয়া…। মাঝি বাইয়া যাওরে অকুল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙা নাওরে মাঝি বাইয়া যাওরে.. ভেনলাকাঠের নৌকা খানি মাঝখানে তার গুইরা (গুরা), নৌকার আগা হতে পিছায় (পিছনে) গেলে গলুই যাবে খইয়ারে (খসে) মাঝি বাইয়া যাওরে। ঘাটে ভিড়াইয়া তরী পান খাইয়া যাওরে.. পান খাইয়া যাও। বাউল সম্রাট ফকির লালনশাহের গানেও নৌকার কথা উল্লেখ রয়েছে। তিনি গেয়েছেন,‘ তোরা কে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়–।’ হাল আমলে একটি উল্লেখযোগ্য গান হলো‘ দে দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিসনা., ছেড়ে দে নৌকা মাঝি যাবো মদীনা। চট্রগ্রাম অঞ্চলে সাম্পানকে নিয়ে গীত হয়, ওরে সাম্পান ওয়ালা .. তুই আমারে করলি দিওয়ানা। ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় রচিত শ্রীকান্ত এবং নতুনদার নৌকা ভ্রমনের কাহিনী কমবেশি সকলেরই জানা। কবি জীবনানন্দ দাসের রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে ‘সেই দিন এই মাঠ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘চারি দিকে শান্ত বাতি-ভিজে গন্ধ- মৃদু কলরব, খেয়া নৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে; পৃথিবীর এই গল্প বেঁচে রবে চিরকাল–। আবার আসিব ফিরে কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘ রূপ্সার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে, ডিঙা বায়- রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে..।
ইদানিং কালের ছড়াকারগণও নৌকা বা নাওকে নিয়ে ছড়া রচনা করেছেন; যেমন; আয়রে আয় টিয়ে নায়ে ভরা দিয়ে, না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে, ওরে ভোঁদড় ফিরে চা খোকার নাচন দেখে যা।
যেকোন নৌকা বাইতে গেলে লগি বৈঠার প্রয়োজন হয়। এদেশে কখনো কখনো তা রাজনৈতিক কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে যা নাকি খুবই দুঃখ ও বেদনা দায়ক বটে। আগেকার দিনে নৌকা চলতো পালের হাওয়াতে। এখনো এদেশে একটি প্রবাদ আছে ওমুকের পালে হাওয়া লেগেছে অর্থাৎ তার দিনকাল ভালো যাচ্ছে। মাস্তুলসহ পাল তোলা নৌকায় হাওয়া বা বাতাস না পেলে নৌকায় গুন টানা হতো।
১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নৌকার মাঝি-মাল্লা এবং নোঙরকে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শিল্পীদের গাওয়া বিভিন্ন ধরনের গান মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। যেমন, নোঙ্গর তোল তোল সময় যে হলো হলো … নোঙ্গর তোল তোল। আমরা ক’জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করেরে… তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে। মুজিব বাইয়া যাওরে …..। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। সেসময় ভারতে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা ট্রেনিং শেষে ভারত সরকার প্রায় প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা দলের জন্য ছয় দাঁড়ের নৌকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। সেই সকল নৌকায় পাল তোলা এবং গুণ টানারও ব্যবস্থা ছিলো। সেই নৌকায় চড়ে মুক্তিযোদ্ধাগণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় পা-চাটা দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশাম্স ও পিসকমিটির লোকদেরকে অতর্কিতে আক্রমণ করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌ-আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়তো। কোন কোন সময় আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাগণ যখন নৌকায় পাল তুলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতো তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা অবাক বিষ্ময়ে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতো। তারা বলতো ‘মুক্তি ফৌজ এইছা চিজ হায় উহনে হাওয়া পাকাড় কর ভাগ জাতা হায়।’
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকার কদর দেখে বাংলার তৎকালীন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানী, অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তরুন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগকে মোকাবিলা করার জন্য ২১ দফাকে সামনে রেখে যখন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন করেন তখন নৌকাকে তাঁদের দলীয় প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেন। হক-ভাসানীর নৌকায় ভোট দিবার জন্য জনগণকে দারুনভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়। উক্ত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং যুক্তফ্রন্ট নৌকা প্রতিকে নির্বাচন করে ২২৩টি আসন লাভ করে। আর সেথেকেই এদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে নৌকাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নৌকা প্রতিক নিয়ে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি কর্তৃক বাঙালির ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে না দেওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহ্বানে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ নয় মাস ধরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এবছর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এজন্য নৌকাকে বাংলার মানুষের মুক্তির প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনসহ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নৌকাকেই দলীয় প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করে চলেছে। বিগত ২০০৮ সালের ২২ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের প্রতীক ছিলো নৌকা। এই নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়ার বদৌলতেই মহাজোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এবার ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। নৌকা তাই বাংলার মানুষের প্রাণের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত। তবে মহাজোটের মধ্য থেকে ইদানিং কোন কোন শরীকদলের নেতৃবৃন্দ মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য নানারকম বুলি আওড়িয়ে চলেছেন।
দু নৌকায় পা’ রাখা বা পাঁড়া দেওয়া বলে একটি কথা এদেশে প্রচলিত রয়েছে। আর দু’নৌকায় পা রাখলে তার পরিণতি যে কিহয় তা যারা করেন তারাই ভলো বলতে পারেন। কথায় বলে জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
তারিখ ২৩/ ১২ / ২০২৩.