১৪৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ‘টাইমড আউট’ হয়েছেন শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। গত পরশু দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ‘টাইমড আউট’ ঘোষণা করেছেন আম্পায়াররা।
ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ম্যাথুসের এই ‘টাইমড আউট’ হওয়া ও তাকে সাকিবের ‘টাইমড আউট’ করা নিয়ে ক্রিকেট দুনিয়ায় চলছে বিতর্ক-যুদ্ধ। যুদ্ধ লেগে গেছে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের মধ্যেও। সাকিব এবং ম্যাথুসের সঙ্গে যুদ্ধ তো আছেই। ম্যাথুসের বিতর্কিত আউটের হতাশা তো আছেই, সঙ্গে লঙ্কানরা ম্যাচটাও হেরেছে ৩ উইকেটে। দুই হতাশাকে একবিন্দুতে মিলিয়ে শ্রীলঙ্কানরা সত্যিকার যুদ্ধই শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। পাশাপাশি বিতর্ক-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন ক্রিকেট দুনিয়ার সাবেক ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার এবং সমর্থকরাও।
সামাজিক যোগাযোগের আলোচনা-সমালোচনার বান বইছে। কেউ কেউ ম্যাথুসের পক্ষে দাঁড়িয়ে সাকিবকে কাঠগড়ায় তুলে ধুয়ে দিয়েছেন। বলেছেন সাকিব, ক্রিকেটের চেতনাবিরোধী কাজ করেছেন। কেউ আবার দাঁড়িয়েছেন সাকিবের পক্ষে। যুক্তি দিয়েছেন, আইনে যেহেতু ‘টাইমড আউটে’র বিষয়টি আছে, সুতরাং সাকিব ভুল করেননি। এই প্রতিবেদনে বিতর্কিত ‘টাইমড আউট’ নিয়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার খণ্ডচিত্রগুলো তুলে ধরা হলো—
১. শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের যুদ্ধ
ম্যাথুসের ‘টাইমড আউট’ নিয়ে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের হতাশ হওয়াটা স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু হতাশা ছাপিয়ে তারা রীতিমতো যুদ্ধংদেহি মনোভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ম্যাচ চলাকালেই বাংলাদেশ ইনিংসের শেষ দিকে তাওহিদ হূদয়ের সঙ্গে বাদানুবাদ করেন অধিনায়ক কুশল মেন্ডিসসহ শ্রীলঙ্কার একাধিক ক্রিকেটার। তবে আসল বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের ‘আসল যুদ্ধ’টা দেখা গেছে ম্যাচ শেষের সৌজন্যের করমর্দন পর্বে। বাংলাদেশ দল ‘হাত মেলানো’র জন্য প্রস্তুত থাকলেও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা হাত মেলাননি। হাত মেলানোর আগেই তারা তড়িঘড়ি করে মাঠ থেকে বেরিয়ে যান। ইচ্ছা থাকলেও বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা হাত মেলাতে পারেননি।
২. শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের হাত না মেলানো নিয়ে ম্যাথুসের ব্যাখ্যা
মাঠে যত যাই ঘটুক, সেই তিক্ততা ভুলে ম্যাচ শেষে দুই দলের ক্রিকেটারদের সৌজন্যের হাত মেলানো ক্রিকেটীয় চেতনার অংশ। প্রতিটা ম্যাচ শেষেই দল বেঁধে হাত মিলিয়ে থাকেন দুই দলের ক্রিকেটাররা। কিন্তু গত পরশু ম্যাথুসের ‘টাইমড আউট’ ক্ষুব্ধতায় শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা হাত মেলাননি। কেন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলাল না, ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধি হয়ে আসা ম্যাথুসকে প্রশ্নটা করা হলে তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘আপনি তো তাদেরই সম্মান জানাবেন, যারা আপনাদের সম্মান করবে।’
৩. হাত না মেলানো নিয়ে সাকিব যা বলেছেন
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকেও হাত না মেলানোর ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। সাকিব উত্তরটা দিয়েছেন এভাবে, ‘খেলা শেষে (শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের সঙ্গে) কোনো কথা হয়নি। আমরা (হাত মেলানো) মেলাইনি, ব্যাপারটা তা নয়। আসলে ওরাই চলে গেছে।’
৪. বাংলাদেশ দল ও সাকিবকে নিয়ে ম্যাথুসের মন্তব্য
নিজের ‘টাইমড আউট’ নিয়ে ম্যাথুস এতটাই ক্ষুব্ধ যে, তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ দল এবং সাকিবের প্রতি তার আর কোনো সম্মান নেই! ম্যাথুস বলেছেন, ‘আমি জানি না কাণ্ডজ্ঞান কোথায় হারিয়ে গেল। এটা অবশ্যই সাকিব এবং বাংলাদেশের জন্য লজ্জাজনক ব্যাপার। ওরা যদি (বাংলাদেশ) এভাবেই খেলতে চায় এবং এতটা নিচে নামে, আমার তো মনে হয় ওদের মধ্যে বড়সড় একটা সমস্যা আছে।’ নিজেকে সঠিক প্রমাণ দাবি করে আম্পায়ারকেও কাঠগড়ায় তুলেছেন ম্যাথুস। বলেছেন, তিনি যথাসময়েই খেলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, আম্পায়ার ভুল করে তাকে আউট দিয়েছেন।
৫. নিজেকে সঠিক প্রমাণে ম্যাথুসের প্রমাণ
বিশ্বকাপের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাটসম্যান আউট হলে বা আহত হয়ে স্বেচ্ছা অবসর নিলে নতুন ব্যাটসম্যানকে দুই মিনিটের মধ্যে বল খেলার জন্য প্রস্তুত হতে হয়। কিন্তু পরশু দুই মিনিট পেরিয়ে যাওয়ায় ‘টাইমড আউট’ হয়েছেন ম্যাথুস। কিন্তু ম্যাথুসের দাবি—তিনি দুই মিনিটের মধ্যেই খেলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। সাকিবের ভুল আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আম্পায়ার তাকে ভুল আউট দিয়েছেন। নিজের দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাশাপাশি দুটি ছবি পোস্ট করেছেন। একটা যার আউটের পর তিনি মাঠে নামেন, সেই সাদিরা সামারাবিক্রমার ক্যাচ নেওয়ার সময়ের ছবি। ক্যাচটি নেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। অন্যটা তিনি হেলমেট পরে খেলার জন্য তৈরি হওয়ার ছবি। দুটি ছবির ওপরেই ঘড়ির সময় উল্লেখ করা আছে। মাহমুদউল্লাহর ক্যাচ নেওয়ার ছবির ওপরে সময় লেখা ৩টা ৪৮ মিনিট ৫০.১৬ সেকেন্ড। দ্বিতীয় ছবিটা ম্যাথুসের হেলমেট খোলার চেষ্টার সময়ের, তার ওপরের ঘড়িতে সময় ৩টা ৫০ মিনিট ৪৫.১৪ সেকেন্ড। ছবির ক্যাপশনে ম্যাথুস লিখেছেন, ‘প্রমাণ! ক্যাচ নেওয়ার সময় ও হেলমেটের স্ট্র্যাপ খুলে যাওয়ার সময়।’
৬. আবেদনের সিদ্ধান্তকে সঠিক দাবি করে সাকিবের মন্তব্য
ম্যাথুস তার আউটের জন্য সাকিব এবং বাংলাদেশ দলকে কাঠগড়ায় বলেছেন বটে; তবে সাকিব নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক দাবি করেছেন। বলেছেন, ‘এটা ঠিক না বেঠিক, সেটা আমি জানি না। এটা আইনে আছে। আর আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হতো। দলের জয় নিশ্চিত করতে যা করা দরকার আমি তা করব। ঠিক-বেঠিকের বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু যদি আইনে থাকে, তাহলে আমার এই সুযোগগুলো নিতে আপত্তি নেই।
৭. সাবেক ক্রিকেটারদের কে কার পক্ষে
ম্যাথুসের ‘টাইমড আউট’ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বের সাবেক ক্রিকেটাররাও। কেউ ম্যাথুসের পক্ষ নিয়ে সাকিবকে ধুয়ে দিয়েছেন, কেউ আবার সাকিবের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন। ম্যাথুসের পক্ষে দাঁড়িয়ে সাকিবের বিরোধী ক্রিকেটের চেতনাবিরোধী কাজের অভিযোগ তুলেছেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ওয়াসিম আকরাম, মিসবাহ-উল-হক, শোয়েব আখতার, শোয়েব মালিক, আজহার আলি, ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ভেঙ্কট প্রসাদ, হরভজন সিংসহ অনেকেই। তবে পাকিস্তানেরই সাবেক অধিনায়ক মঈন খান আবার সাকিবের পক্ষে বলেছেন। সাকিবের সিদ্ধান্তকে যথার্থ দাবি করে মঈন খান বলেছেন, ‘আইন অনুযায়ী ওর (সাকিবের) সিদ্ধান্ত সঠিক। সেখানে যদি দলের জয়-পরাজয়ের ব্যাপার থাকে, তাহলে এটা অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত। সে (সাকিব) নিজেও সেটাই বলেছে। যদি আমি ওর জায়গায় থাকতাম, তাহলে হয়তো আমি নিজেও টাইমড আউটের আবেদনই করতাম।’
ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ঘটে যাওয়া এই ‘টাইমড আউট’ নিয়ে বিতর্ক যে আরো চলবে, সেটা অনুমিতই। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার যে যুদ্ধ শুরু হলো, সেটা হয়তো চলবে দীর্ঘদিন!