আবদুল জব্বার
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সংকট ক্রমাগত ঘনীভূত হচ্ছে, সেই সাথে জটিল হয়ে পড়ছে দেশের বড় দুই দলের সমঝোতার পথ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র রাজনৈতিক দ্বন্দ প্রকট হওয়ায় সমাধানের পথ দেখছে না বিশ্লেষকরা। এক দলের প্রতি অন্যদলের হুমকি ধামকি সংঘাতের পথই বিস্তৃত করছে। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন নভেম্বরে নির্বাচনী তফসিল ঘোষনার পর পাল্টে যেতে পারে রাজনৈতিক চিত্র।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দল মাঠে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনে প্রস্তুত। এমন সংকটে আর সংলাপে সমাধানের পথ নেই। তারা মনে করেন, দেশের মানুষের সার্বিক স্বার্থেই এক হতে হবে দুই পক্ষকেই। বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ মহাযাত্রা শুরু করা হবে। তারপর থেকে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি থেমে থাকবে না। তিনি বলেছেন, আর কয়েকদিন মাত্র সময় আছে। দূর্গা পূজার ছুটির মধ্যে সরকার পদত্যাগ করবে নাকি জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যূত হবে। এ বিষয়টি ভেবে দেখার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। এখন বিএনপি’র দাবী নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে অবস্থানের কোনো পরিবর্তন করেনি জাতিসংঘ। নির্বাচনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে সব দল মাঠ দখলে ব্যস্ত। সরকার ও বিরোধী দল সবারই চাওয়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে নিশ্চিত হবে সেটা নিয়েই চলছে নানা রকম আলাপ আলোচনা।
সরকারি দল বলছে, তাদের অধীনেই অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। অন্যদিকে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সহ অন্যরা বলছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন আমরা দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই তারা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এই বক্তব্যে এখন পর্যন্ত অনড়। রাজনৈতিক এমন পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নানা রকম কথা বলছে। এরই অংশ হিসেবে গত ৯ অক্টোবর মার্কিন নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল দেশের প্রধান দেশের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র পাশাপাশি সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছে। কিন্তু এই বৈঠকেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে। ফলে বড় হচ্ছে রাজনীতির মাঠে সংঘাতের আশংকা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাতকারে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।
পর পর গত ৩টি জাতীয় সংসদের তুলনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলতি একাদশ সংসদে উন্নতি থাকলেও এটি প্রত্যাশ্বিত মাত্রায় কার্যকর নয় বলে মনে করেন ট্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সংসদ প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পেরেছে, এমন বলার সুযোগ নেই।
সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও কার্যকর বিরোধী দলের অভাবের কারণে মূলত প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। চলতি মাসের ১ অক্টোবর রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান এসব কথা বলেন। টিআইবির ওই গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম থেকে ২২তম অধিবেশনে কোরাম সংকটে যে সময় ব্যয় হয়েছে, তার প্রাক্কলিত অর্থমূল্য ৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে আমাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন থাকা আওয়ামী লীগ সরকার যেকোনো মূল্যে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর।
দেশের বামগণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম শরিকদল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে দেশে যে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে তার সযোগ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি। তারা সরকার পরিবর্তনের ভয় দেখিয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে, দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে এই অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে আওয়ামী লীগ। সিপিবি নেতা একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকারে নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে বলেছেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত নির্দলীয় তদারকি সরকারের হাতে সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। তিনি দাবী করে বলেছেন এটাই সবাই চাইছে এবং এটাই একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান। অন্যথায় বর্তমান পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশংকা রয়েছে, দেশের ক্ষতি হতে পারে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপকালে বর্ষিয়ান এই কমিউনিস্ট নেতা এ কথাগুলো বলেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ বলছে তদারকি সরকারের সংবিধানে নেই। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের বিধান তো সংবিধানে আছে। সেই বিধান প্রয়োগ করে তদারকি সরকারের অধিনে নির্বাচন সম্ভব। তিনি বলেছেন, আমি রুপরেখা প্রনয়নের বিধান বলে দেব। সিপিবি নেতা স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রথম নির্বাচিত ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, সাবেক স্বৈরাচার এরশাদ বিরেধী আন্দোলনের সময় নির্বাচনের রুপরেখা প্রনয়নের প্রধান কারিগর ছিলাম। কত তারিখে কীভাবে কী করতে হবে, কীভাবে সরকার পদত্যাগ করবে সবকিছুর রুপরেখা দেব। কিন্তু সেই ইচ্ছা সরকারের থাকতে হবে। এরপর তিনি বলেছেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, আর স্থিতিশীলতার জন্য ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা সরকারের থাকতে হবে।
ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইসি রাজিব কুমার বলেছেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের একটাই কাজ ভোটার ও প্রার্থীর আস্থা অর্জন করা। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে আমরা সেটাই করি। তিনি আরো বলেন, ভারতের নির্বাচন কমিশন এখন সবার কাছেই আস্থাশীল।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদের) প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান ভূইয়া বলেছেন, স্বাধীনতার ৫১ বছর পর দেশে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা স্বাধীন দেশের জন্য মর্যাদা হানিকর তো বটেই, গণতন্ত্র চর্চা বা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ যে কতটা রসাতলে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যে জনগণের শাসন পরিচালনার অংশ হিসেবে নির্বাচন সে জনগণের কোনো খবর নেই, বাইরের মহলের মাথা ব্যাথার শেষ নেই। তিনি বলেছেন, বিদ্যমান দুই পক্ষ চর দখলের মহড়ায় মেতেছে। বিদেশীরা এসে ভীড় জমিয়েছে। এরপর তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছেন, সেক্ষেত্রে কেমন নির্বাচন আশা করা যায়?
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধিকে এ কথা বলেন। যা পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সস্বস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এক্ষেত্রে তারা স্টাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। গত ১৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনার মোঃ আলমগীর বিষয়টি জানিয়েছেন। তার এ বক্তব্য পরদিন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
এক রক্তক্ষয়ী সস্বস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সাম্প্রদায়িক শক্তি বাদে দেশের সকল রাজনৈতিক দল, সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সমর্থন দিয়েছিলেন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবার দেওয়ার কারনে অনেক পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এখনো দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে অন্ধকারে রেখে অতীতে কোনো সফলতা আসেনি, ভবিষ্যতেও আসবে না। নির্বাচনে দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল পক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন। আর এই উদ্যোগ নিতে হবে ক্ষমতাসীন সরকারকেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ ভূমিকাই হতে পারে চলমান সংকট উত্তোলনের একমাত্র পথ।
লেখক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
আবদুল জব্বার
প্রধান সম্পাদক, অনাবিল সংবাদ
পাবনা।