ফেলে আসা দিন গুলো – ৪৯

— এবাদত আলী —
আসলে সাংবাদিক শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা রোমাঞ্চকর ভাব লুকিয়ে রয়েছে। তাইতো এর প্রতি মানুষের কৌতুহল অনেক বেশি। তখন সাংবাদিকের দেখা পাওয়াই ছিলো দুষ্কর। সেসময় সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান প্রেসক্লাব পাবনা সদর মহকুমায় ছিলো মাত্র ২টি। পাবনা ও ঈশ^রদী পেসক্লাব। পাবনা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালের ১ মে তারিখে। আর ঈশ^রদী প্রেসক্লাব তারও পরে। সিরাজগঞ্জ মহকুমায় ছিলো সিারজগঞ্জ ও উল্লাপাড়া প্রেসক্লাব।
তখন ১৯৭৮ সালের মে মাস। আটঘরিয়াতে সাংবাদিকদের জন্য একটি প্রেসক্লাব গঠনের বিষয়ে আমিরুল ইসলাম রাঙার প্রস্তাব আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হলো। কারণ এখানে এই ধরণের মানসিকতার আরো কয়েকজনকে পাওয়া গেল। আটঘরিয়ার রাধাকান্তপুরের আব্দুস সাত্তার মিয়াকে এব্যাপারে উৎসাহিত করা হলো। তিনি ছোট বেলা থেকেই লেখা-লেখির সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি তখন আটঘরিয়া থানা শিক্ষা অফিসের হেডক্লার্ক পদে কর্মরত। অফিসের কাজের ফাঁকে তিনিও খুলনার দৈনিক জনবার্তা নামে একটি পত্রিকায় আটঘরিয়া প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ পাঠাতেন।
আরেক জন ছিলেন আটঘরিয়া পশু হাসপাতালের ডাক্তার আব্দুল কাদেরের বড় ছেলে সিরাজুদ দাহার মাতলু ওরফে এস দাহার মাতলু। পিতার চাকরির সুবাদে আটঘরিয়ার দেবোত্তরেই থাকতেন। তিনি ও পত্র-পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন।
একদিন আমিরুল ইসলাম রাঙা, আব্দুস সাত্তার মিয়া ও এস দাহার মাতলুকে নিয়ে আমার অফিসে এলো এবং আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ করলো। আরো এলেন আটঘরিয়া বিআরডিবিতে কর্মরত বেরুয়ান গ্রামের মোঃ হাসান আলী ও শ্রীকান্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক কয়রাবাড়ি গ্রামের মোহাম্মদ ইয়াছিন।
আমি এতদিনে এই বিষয় নিয়ে বেশকিছু চিন্তা ভাবনা করে রেখেছিলাম। শুধু সময়ের অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম। সেদনিই অফিস ছুটির পর পড়ন্ত বিকেলে আমরা দেবোত্তর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দুর্বাঘাসের মধ্যে বসে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেই। পরে দেবোত্তর বাজারের একমাত্র চায়ের দোকান অর্থাৎ মজিবর রহমান ঠান্ডার চায়ের দোকানে বসে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
এদিনটি ছিলো ১৯৭৮ সালের ৭ মে। আমিরুল ইসলাম রাঙার প্রস্তাবে সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে (এবাদত আলী) সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত করা হয় এবং আবদুস সাত্তার মিয়া সাধারণ সম্পাদক, আমিরুল ইসলাম রাঙা, মোঃ হাসান আলী, মোহাম্মদ ইয়াছিন ও এস দাহার মাতলু (সিরাজুদ দাহার) সদস্য হন।
আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের পর পরই আরো দুজন, যেমন পাবনা সদরের মনোহরপুর গ্রামের এইচ কেএম আবু বকর সিদ্দিক ও আটঘরিয়ার চাঁদপুর গ্রামের মোসলেম উদ্দিনকে সদস্য করা হয়। পরবর্তীকালে টেবুনিয়া বারইপাড়ার আব্দুস সাত্তার চৌধুরী ও আব্দুল কুদ্দুস সাগর এই প্রেসক্লাবের সদস্য পদ লাভ করেন।
মজিবর রহমান ঠান্ডার চায়ের দোকানে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠন করা হলো কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য বসার কোন ব্যবস্থা হলোনা। ঠান্ডার দোকানের উত্তর পাশে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পড়ে ছিলো। আমরা প্রস্তাব দিতেই তিনি সেখানে ঢেউ টিনের একটি ছাপড়া ঘর তৈরি করে দিলেন। নামমাত্র ভাড়ায় আমরা সেখনে প্রেসক্লাবের জন্য অফিস ঘর বানালাম। কিন্তু চেয়ার-টেবিল পাবো কোথায়? সকলে মিলে চাঁদা-হারি তুলে ৭৫ টাকা দরে খান কয়েক চেয়ার এবং ১০০ টাকা দরে দুটো টেবিল টেবুনিয়ার হাট থেকে ক্রয় করে বসার এবং খাতাপত্র রাখার ব্যবস্থা করা হলো। পাটখড়ির বেড়া দেওয়া জানালা বিহীন ভাড়া ঘরে বসেই সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার বিষয় নিয়ে প্রতিদিন বিকালে আমরা আলাপ আলোচনায় মত্ত হতাম।
আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের পরপরই এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। গন্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই সহযোগীতা করার জন্য এগিয়ে আসেন। বিশেষ করে দেবোত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার মোল্লা, দেবোত্তরের সৈয়দ নাসিরুজ্জামান, রাধাকান্তপুরের জাহাঙ্গীর আলম ঘুটু প্রমুখ ব্যক্তিগণ প্রেসক্লাবের ব্যাপারে দারুনভাবে উৎসাহি হওয়ায় চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার মোল্লাকে প্রধান উপদেষ্টা এবং সৈয়দ নাসিরুজ্জামান ও জাহাঙ্গীর আলম ঘুটুকে সদস্য করে একটি উপদেষ্টা পরিষদও গঠন করা হয়।
কেবলমাত্র সাংবাদিকদের সমম্বয়ে গঠিত প্রেসক্লাব। এই ক্লাবের সদস্য হতে গেলে তাকে অবশ্যই সাংবাদিক হতে হবে। কিন্তু একজন সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারি সাংবাদিকতা করতে পারে কিনা। তবে এর পক্ষে যে যুক্তি তাহলো, মফস্বল এলাকায় যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই হলো সৌখিন সাংবাদিক। পার্ট টাইম জব। এতে নিজের কাজে ফাঁকি না দিলেই হলো।
তবে আমার জন্য বিষয়টি একটু ভিন্ন ছিলো। আমার চাকরি ছিলো সরাসরি কলেক্টরেটের অধীনে। অর্থাৎ নিয়োগ ও বদলির ক্ষমতা কালেক্টরের হাতে। তখন পাবনার কালেক্টর বা ডিসি ছিলেন এম এ জব্বার। অপরদিকে আমাকে বাংলাদেশ ভুমি অফিসার্স কল্যাণ সমিতি পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়। পাবনা সদর মহকুমা ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা মিলে পাবনা জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদের সুবাদে ডিসি মহোদয়ের নিকট আমি বিশেষ পরিচিত ছিলাম। কিন্তু তারপরও তো কথা থাকে। সত্যি কথা বলতে কি আমি তখন এবিষয়ে নিজের দুর্বলতা ঢাকার পক্ষে নানা যুক্তি দাঁড় করাতে থাকি। এমন সময় পত্রিকা মারফত জানতে পারি কিশোরগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি। তিনি যদি সরকারি কর্মকর্তা হয়ে প্রেসক্লাবের সভাপতি হতে পারেন তাহলে আমি পারবোনা কেন। তবে আশার কথা এই যে,এই বিষয় নিয়ে কেউ কোনদিন কোন প্রশ্ন তোলেনি। আর আমরা নিজেদের দায়িত্ব ফেলে রেখে কেউই ও পথে পা বাড়াতাম না।
সে যাক। প্রেসক্লাব গঠনের পরপরই অর্থাৎ ১৭ মে-১৯৭৮ তারিখে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান আটঘরিয়া কলেজে আগমণ করবেন এবং কলেজ মাঠে জনসভায় ভাষণ দিবেন। আটঘরিয়ার রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দের পরামর্শ মোতাবেক আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের পক্ষ হতে প্রেসক্লাবের সভাপতি উক্ত জনসভায় বক্তব্য রেখে রাষ্ট্রপতিকে আটঘরিয়া বাসীর অভাব অভিযোগ নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি আটঘরিয়া প্রেসক্লাব সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের আগমণে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের পক্ষ হতে একটি ব্যানার লেখা হলো। ব্যানারটি লিখে দেন প্রেসক্লাব সদস্য আর্টিষ্ট আব্দুল কুদ্দুস সাগর।
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ পাবো ভাবতে বেশ ভালোই লাগছিলো। তাছাড়া আরেকটি অভিপ্রায় ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধের সুচনালগ্নে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ যিনি চট্রগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন, এবং তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন বিধায় এই বিরোচিত ব্যক্তিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে একটি মানপত্র প্রদানেরও সিদ্ধান্ত হয়।
এ ব্যাপারে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে যাবার সময় প্রত্যেক সাংবাদিকের জন্য আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের ব্যাজ এবং একটি ব্যানার থাকবে। জনসভায় সাংবাদিকদের বসার জন্য পৃথক জায়গার ব্যবস্থা কথা মিটিংিএ জানানো হয়। সভায় মানপত্র প্রদানের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। যেহেতু নব গঠিত প্রেসক্লাব তাই এব্যাপারে কেউ কোন দ্বিমত পোষণ করলেন না। সভায় প্রেসক্লাবের সদস্য আমিরুল ইসলাম রাঙার ওপর মানপত্রটি লেখা এবং বাঁধানোর ভার দেওয়া হলো। । (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
তারিখ: ৩০/০৯/২০২৩.