// নাজিম হাসান,রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি:
রাজশাহী কোর্ট মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ একেএম কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, সীমাহীন অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতায় ২৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তি, বেতন, ফরম ফিলাপ, কেন্দ্র ফিসহ বিভিন্ন ফান্ডের রশিদ পাল্টিয়ে নিয়েছেন ভয়াবহ দুর্নীতির আশ্রয়।কলেজের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না দিয়ে করেছেন তছরুপ। গত সাড়ে সাত বছরে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে তিনি কলেজের বিভিন্ন খাত থেকে দুই কোটি টাকা সরিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। এ ঘটনায় অধ্যক্ষের অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কলেজের সাবেক হিসাবরক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন রাজশাহীর সিনিয়র স্পেশাল মেট্রো দায়রা জজ আদালতে দুইটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় কলেজ অধ্যক্ষ এবং তার দুর্নীতির সহযোগী আরও তিন শিক্ষককে আসামি করা হয়েছে। মামলার তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর এ দুটি মামলায় সাক্ষী রয়েছেন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বর্তমান উপাধ্যক্ষ রবিউল আলমসহ ১৭ জন শিক্ষক। জানা গেছে, অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের রাজশাহী মহানগরীর ভদ্রা এলাকায় রয়েছে সাড়ে ১০ কাঠা জমি। এ জমির বর্তমান বাজার মূল্য সাত কোটি টাকা। তবে এ জমি কয়েক বছর আগে ৮৫ লাখ টাকায় কিনেছেন বলে দাবি করেছেন অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান। এছাড়া মহানগরীর উপকণ্ঠ লিলি সিনেমা হলের মোড় এলাকায় কিনেছেন আরও তিন কাঠা জমি। এ জমির মূল্যও চলতি বাজারে কোটি টাকা। ছেলেকে নিজ খরচে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছেন কানাডায়। অভিযোগ উঠেছে, অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান দৃশ্যমান দুর্নীতির বাইরেও কলেজের মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষের চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে তিনি জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য বরাবর আবেদন করেছেন। অপরদিকে কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা বর্তমান অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাবির উপাচার্য বরাবর আবেদন করেছেন। এছাড়াও সাবেক অধ্যক্ষ বাদশা বর্তমান অধ্যক্ষের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) বেসরকারি কলেজ শাখায় অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক প্রলয় দাস তদন্ত শুরু করেন। তবে এ তদন্তে অধ্যক্ষ সহযোগিতা করেন নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা লিখিতভাবে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। এছাড়া দুর্নীতি এবং অণিয়মের প্রতিবাদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধিকাংশ শিক্ষক ও কর্মচারী অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে এবং সমস্ত প্রমাণাদি সংরক্ষিত আছে। মামলার বাদী কলেজের সাবেক হিসাবরক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেন না। তিনি দৃশ্যমান দুর্নীতির মাধ্যমে কলেজের দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর অদৃশ্যমান দুর্নীতি করে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন, সেটি বলতে পারব না। তার অনিয়ম আর দুর্নীতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন হয়, একারণে মামলা করেছি। অধ্যক্ষের এ ধরনের কর্মকা-ে একাডেমিক কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধিকাংশ শিক্ষক এবং কর্মচারী তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। আদালতে দায়েরকৃত দুইটি মামলার এজাহার এবং সাবেক অধ্যক্ষের জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে আবেদনে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের ক্ষমতার অপব্যবহার, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং আর্থিক অনিয়মের ২৩টি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। কামরুজ্জামান ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। এরপরই বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, অধ্যক্ষের এ অপকর্মে তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন- দর্শন বিভাগের প্রভাষক কামরুন নাহার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রিয়াজুল হাসান, ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক হাসানুজ্জামান এবং ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মশিউর রহমান।মামলার এজাহার এবং অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্টে ২৪ জন শিক্ষক নিয়োগে নজিরবিহিন দুর্নীতি করেন অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান। নিয়োগকৃত শিক্ষকদের কাছ থেকে কলেজের উন্নয়নের জন্য অনুদান হিসেবে ৫৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আদায় করেন। কিন্তু তিনি অগ্রণী ব্যাংক, রাজশাহী মহানগরীর কোর্ট বাজার শাখায় কলেজের অ্যাকাউন্টে (০২০০০১০০০৬৪৮১) জমা দিয়েছেন ৩৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা। বাকি ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। বেসরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী একজন অধ্যক্ষ মাসের শেষে পাঁচ হাজারের বেশি টাকা জমা রাখতে পারবেন না। কিন্তু অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এক লাখ ৩৩ হাজার ৪৫২ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে নয় লাখ ৮৩ হাজার ৭৫২ টাকা এবং ২০২০-২১ সালে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিজের কাছে রাখেন। পরবর্তীতে এ টাকা আর কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা দেন নি। এভাবে তিনি ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ২০৪ টাকা হাতিয়ে নেন। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক সম্মান শ্রেণীর প্রথমবর্ষের ফরম পূরণে শিক্ষার্থী প্রতি রশিদের মাধ্যমে চার হাজার ৫০০ টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে রশিদ পাল্টিয়ে দুই হাজার ৫০০ টাকা অগ্রণী ব্যাংক, কোর্ট বাজার শাখায় কলেজের অ্যাকাউন্টে (১০০৬৪৬৮১) জমা করেন। এভাবে শিক্ষার্থী প্রতি দুই হাজার টাকা করে আত্মসাৎ করেন অধ্যক্ষ। মোট ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এছাড়া একই বর্ষের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাবদ সাত লাখ ৪৩ হাজার টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয় চার লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা। অবশিষ্ট দুই লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় শিক্ষার্থী প্রতি তিন হাজার ৩০০ টাকা করে নেওয়া হয়। কিন্তু ওই একই অ্যাকাউন্টে তিন হাজার টাকা করে জমা দেওয়া হয়। এভাবে শিক্ষার্থী প্রতি তিনশ টাকা কম জমা দিয়ে এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। একইভাবে ২০১৯-২০ বর্ষের শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের বিএ, বিএসসি ও বিকম পাস কোর্সের শিক্ষার্থীদের জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ফরম পূরণ বাবদ ৬১ হাজার ২০০ টাকা আদায় করেন। কিন্তু ওই টাকা ব্যাংকে জমা করেন নি। ২০১৮-১৯ বর্ষের সম্মান শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে কলেজের উন্নয়ন ফি এবং সেমিনার ফি বাবদ টাকা আদায়ের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন কলেজ অধ্যক্ষ। একই শিক্ষাবর্ষের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরি কার্ডের নামে আরও তিন লাখ টাকা আদায় করেন অধ্যক্ষ। কিন্তু এ টাকাও কলেজ অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন তিনি। একইভাবে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণীতে ম্যানুয়ালভাবে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাঁচশ ৫০ টাকা টাকা করে আদায় করা হয়। কিন্তু সেটিও অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে ২০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এদিকে ২০২০ সালে দুই হাজার ২০০ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর ৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা এবং ২০২১ সালে এক হাজার ৮০০ পরীক্ষার্থীর কেন্দ্র ফি বাবদ আদায়কৃত দুই লাখ ৮৮ হাজার টাকা কলেজ অ্যাকাউন্টে জমা দেন নি অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান। এছাড়া তিনি ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর কোনো ভাউচার ছাড়া তিন লাখ ৫৬ হাজার টাকা কলেজের বিভিন্ন খাতে ব্যয় দেখিয়েছেন। এর অধিকাংশ টাকায় তিনি লোপাট করেছেন। এছাড়া কলেজের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ থেকেও অধ্যক্ষ হাতিয়ে নিয়েছেন ছয় লাখ টাকা। এক্ষেত্রে তিনি কোটেশন বা দরপত্র আহবান করেন নি। ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাবদ প্রায় সাত লাখ টাকা ফেরত দেন নি অধ্যক্ষ। এটি সম্পুর্ণই হাতিয়ে নেন অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান। তাছাড়াও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন খাত থেকে আরও ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া উত্থাপিত মোট ২৩টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একাদশ থেকে সম্মান শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি (বেতন), কোটেশন বা দরপত্র ছাড়া কলেজের উন্নয়ন কাজ, সেমিনার ফি, লাইব্রেরির উন্নয়ন, ভুয়া ভাউচার দিয়ে আপ্যায়নসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে তিনি মোট দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, বর্তমান অধ্যক্ষ শক্তিশালী একটি বিশেষ মহলের আর্শীবাদে লাগামহীন দুর্নীতি করে চলেছেন। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। দুদক মামলা তদন্ত করছে। তিনি আবারও চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছেন। আমি আশা করছি, এরকম দুর্নীতিবাজ একজন ব্যক্তি চাকরির মেয়াদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাড়াবেন না। তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান বলেন, আর্থিক লেনদেন এবং বিভিন্ন খাতে আয়-ব্যয়ের বিষয়টি কলেজের হিসাবরক্ষক দেখেন। অনিয়ম বা দুর্নীতির বিষয়টি তিনিই বলতে পারবেন। আমার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক না। শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগও ভিত্তিহীন। রাজশাহী মহানগরীতে যে জমি কেনা হয়েছে, সেগুলো আমার স্ত্রীর টাকায়। কানাডায় পড়াশোনার জন্য ছেলেকেও আমার স্ত্রী পাঠিয়েছেন। আর আমার বিরুদ্ধে তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগটিও বানোয়াট।#