// এবাদত আলী
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে গারো পাহাড়। সু-উচ্চ গারো পাহাড়ের পাদদেশে বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর জেলার একটি উল্লে¬খযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র- গজনি অবকাশ। গজনি অবকাশে অবকাশ যাপনের জন্য নয়, গারো পাহাড়ের বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে সুশোভিত সৌন্দর্য-মন্ডিত নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি অবলোকন করার মানসেই সেদিন গজনি অবকাশের পিকনিক স্পটে গিয়েছিলাম।
উপজেলা কানুনগো হিসেবে চাকুরির সুবাদে জামালপুরের সরিষাবাড়িতে অবস্থানকালে আমার সুহৃদ আবুল হোসেনের সাথে আগে থেকেই কথা হয়েছিলো। তাই ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে নির্ধারিত দিনের প্রত্যুষে ‘সরকারি বাসা সিমলা বাজার বাংলো’ থেকে তড়িঘড়ি করে জামালপুর রওনা হলাম। পুরাতন ব্রক্ষ্মপুত্র নদের ফেরিঘাটের পাশে পৌছতেই শেরপুর যাবার বাস পাওয়া গেল।
পিচ ঢালা পাকা সড়ক ধরে নন্দির বাজার পাওয়া গেল। নন্দির বাজার থেকে ডাইনে মোড় নিয়ে কুসুমহাটি হয়ে শেরপুর জেলা শহরে পৌঁছলাম। শেরপুর বাসষ্ট্যান্ড হতে আবার একই ধরনের বাসে চেপে বসলাম। শেরপুর থেকে ২০ কিঃ মিঃ দুরে ঝিনাইগাতি পর্যন্ত এই বাসে যেতে হবে।
পাকা সড়কের দু’ধারে বিরাটাকায় সব ঘন গাছ-পালা বলতে গেলে পাহাড়ি অঞ্চলের ছাপ এখান থেকেই শুরু। অতি অল্প সময়েই আমরা ঝিনাইগাতি পৌঁছে গেলাম। ঝিনাইগাতি থেকে গজনি অবকাশের দুরত্ব ৯ কিলোমিটার। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পিকনিকের গাড়ি ছাড়া অন্য কোন যানবাহন চলাচল করেনা বল্লেই চলে। বাস থেকে নেমে একজন বলিষ্ঠ রিক্সা চালককে খোঁজ করতেই আমিনুল নামে এক মধ্যবয়সি রিক্সা চালককে পাওয়া গেল। ঝিনাইগতির দিঘীর পাড়ে তার বাড়ি। পাঁচ কন্যার জনক আমিনুল। পুত্র সন্তান না থাকায় অভাবের সংসারে ঘানি তাকেই টানতে হচ্ছে। ষাট টাকা ভাড়ায় যাওয়া আসার পাশাপাশি তাকে গাইড হিসাবে পাওয়া গেল।
ঝিনাইগাতি সাঈদ হোটেলে চা-নাশতা পর্ব সমাধা করার পর গারো পাহাড়ের গজনি অবকাশে যাত্রা শুরু হলো। ঝিনাইগাতি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের পাশেই গজনী অবকাশ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের টোল ফাঁড়ি। এখান থেকেই পাহাড়ের উচুঁ ভুমিতে ওঠা শুরু। পিচ ঢালা সরু পাকা সড়ক ধরে উজান বেয়ে ধীর গতিতে রিক্সার প্যাডেল ঘুরাচ্ছে আমিনুল। ফাগুনের প্রথম পক্ষের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় আমাদের দেহ মন ফুর ফুরে থাকলেও রিক্সা চালকের শারা শরীর ঘামে তখন জ্যাব জ্যাব করছে।
পাকা সড়কের দু’ধারে উচু নিচু ফসলি জমি। সমতল ভুমিতে প্রচুর ধান জন্মে। বৃষ্টির মৌসুমে পাহাড়ি ঝরনার পানিতে ধানের ফলন খুব বেশি হয়। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রতি বছরই ধান ডুবে যায়। তবুও প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করেই টিকে আছে গারো উপজাতিরা। গারো উপজাতি মহিলারা পুরুষের পাশা পাশি ধান ক্ষেতের পরিচর্যা করে থাকে।
আমরা ক্রমেই পাহাড়ের উচুঁ ভুমিতে উঠছি। রিক্সার প্যাডেল যেন আর ঘুরতে চায় না। তবুও চলতে হবে। এক সময় একটি মোড় পাওয়া গেল। এখান থেকে ডাইনের পথ ধরে হলাদিবাড়ি সীমান্ত ফাড়ি এবং বামে রাংটিয়া সীমান্ত ফাড়ি। আমরা বাম দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চল্লাম। পাশেই ডাইনে রয়েছে সেকান্দর শাহ (রঃ) পীরের মাজার। এখানে প্রতি বছর মহা ধুম-ধামের সাথে ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। ক্রমেই চড়াই উৎড়াই পাহাড়ি পথ। কাংসা ধান শাইল ইউনিয়নের পাকা-সড়ক ধরে আমরা যেন খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে লাগলাম। ঘন অরন্যের মাঝে লাল মাটির পাহাড়। সমগ্র পাহাড় জুড়ে রয়েছে শাল, সেগুন, গজারী, মেহগনি, কড়ই, অর্জুন, হরিতকি, বহেরা, আমলকি, কাঠাল, নিশিন্দা, চন্দনী পায়া, বকন পায়া, আকাশমনি, বান্দর লাঠি, দাতই, কোষ্টি কোঠা, পিরুল্ল¬াহ, জাঠিমৌ, প্রভৃতি ধরণের হাজারো গাছপালা। রিক্সা চালক আমিনুল আরো বহু সংখ্যক গাছের নাম জানে। পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মাঝে মাঝে রয়েছে ঘন বাঁশবন। রাজাবাঁশ, বাটনিবাঁশ, মুরলি বা তরলা বাঁশ, ইত্যাদি। এছাড়া আছে বেত সহ অন্যান্য লতানো গাছপালা।
পাহাড়ের ঢালুতে ফালি ফালি বাইদ বা লেক। এ সময় লেক সমুহ পানি শুন্য। বৃষ্টির মৌসুমে পাহাড়ি ঝরনায় তা টৈটুম্বর হয়। এক সময় আমরা গজনি অবকাশে পৌঁছলাম। অবকাশের প্রবেশপথে বলতে গেলে ফাঁদ পেতে বসে আছে ইজারাদারের লোকজন। রিকসা রাখার নামে পাঁচ টাকা হাতিয়ে নিলো তেলেসমাতি কায়দায়।
এবার পায়ে হেঁটে যাত্রা। গজনি অবকাশ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য স্থানটিকে যে সুশোভিত করে তোলার প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা-স্পষ্টতই বোঝা গেল। উচুঁ পাহাড়ের টিলার বিস্তীর্ণ সমতল ভুমিতে গড়ে তোলা হয়েছে গজনি অবকাশ এর দ্বিতল ভবন। ভবনের সামনে বিশাল চত্বর। চত্বরে ছায়া বেষ্টিত পরিমন্ডল যে কোন পর্যটককেই অতি সহজে আকৃষ্ট করে গজনি অবকাশ কেন্দ্র। পাশেই পিকনিক স্পট। ছুটির দিন বলে বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে লোকজন। কোলাহল মুখর পরিবেশ।
গজনি অবকাশ ভবন হতে সামান্য দূর যেতেই দেখা গেল বিশাল আয়তনের স্মৃতি স্তম্ভ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান ইতিহাসকে সমৃদ্ধি করে রাখার মানসে দেশের প্রান্ত সীমায় গারো পাহাড়ের পাদদেশে উচুঁ পাহাড়ের সমতল ভুমিতে নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতার স্মৃতি স্তম্ভ। স্মৃতি স্তম্ভের আঙিনায় দাড়িয়ে বসে বিভিন্ন পোজে ছবি তোলার ধুম পড়েছে যুবক-যুবতিদের। স্মৃতি স্তম্ভের একপাশে রয়েছে একটি শিশু পার্ক: অন্যদিকে রয়েছে সাইট ভিউ নামে সু-উচ্চ এক টাওয়ার। টাওয়ারটি নির্মিত হয়েছে ১৯৯৯ সালে। এ বছর ২২ অক্টোবর এর আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধন করেন শেরপুর জেলা প্রশাসক নওফেল মিয়া। পাঁচ টাকার বিনিময়ে সু-উচ্চ টাওয়ারের চুড়ায় উঠে টাওয়ার হতে চারিদিকের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি অবলোকন করতে গিয়ে যেন চোখের পলক ফেলা দায়। বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে পাহাড়ি বনভূমি যেন ঘন গাঢ় সবুজে একাকার হয়ে লেপটে আছে কোন এক জাদুকরি শিল্পীর ক্যানভাসে। মাঝে মাঝে এক চিলতে সাদা ফিতার মত এঁেক বেঁকে বয়ে গেছে পাহাড়ি ঝরনার গতিপথ। সাইট ভিউ টাওয়ার থেকে স্পষ্ট দেখা যায় মেঘালয়ের সীমান্ত বরাবর নো ম্যান্স ল্যান্ড, সীমানা পিলারসহ ওপারের ছোট ছোট ঘর-বাড়ি ও ছোট বাজার।
সাইট ভিউ টাওয়ারে অগণিত দর্শনার্থীর ভিড়। এখানে যুবা বৃদ্ধা ও কিশোর কিশোরির মাঝে কোন পার্থক্য নেই। সরু পেঁচানো সিড়ি বেয়ে উঠা-নামা করতে নারী পুরুষের গায়ে মৃদু ধাক্কা বা গা ছুওয়া-ছুওয়ি হলেও কেউ কিছু মনে করে না। কারন টাওয়ারের বিভন্ন অংশে দাড়িয়ে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলতে সবাই যেন ব্যস্ত।
সাইট ভিউ টাওয়ারের পাশেই গড়ে তোলা হচ্ছে একটি চিড়িয়াখানা। এখানে আশে পাশে রয়েছে গোটা তিনেক চায়ের দোকান। একটিতে এক গারো যুবতি চা বিক্রি করছে। নাম তার গৌসালা। বাবার নাম উইলিং। স্বামী রবিন তাকে চা তৈরির কাজে সাহায্য করছে। দোকানের পাশেই ওদের বসত বাড়ি। আমিনুল গৌসালাকে আম্বি (নানী) তোর ফটক নিবো বলে ছবি তোলার জন্য রাজি করালো। বিভিন্ন আঙ্গিকে এই গারো পরিবারের সদস্যদের ছবি তোলা হলো।
গজনী অবকাশ এর পশ্চিম পাশের নিচু সমতল ভুমিতে জম-জমাট বাজার বসে। এখানে বিক্রেতাগণ বাঁশ ও বেতের নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য্য দ্রব্যাদিসহ বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসে। গজনি অবকাশ ভবন চত্বর হতে এই বাজার এলাকায় নামার জন্য রয়েছে একটি সিড়ি। এটির নাম পদ্ম সিড়ি। পাশেই রয়েছে পাহাড়ের একটি বিশাল গহ্বর। এই গুহার ভিতর রয়েছে ক্যান্টিন ও ফাঁকা জায়গা। বেশীর ভাগ তরুন-তরুনীই এখানে আড্ডা জমায়। পাশের লেকে রয়েছে বোট। জিশান প্যাডেল বোটে চেপে বিশাল লেকে আনন্দ ভ্রমণ করা যায়।
গজনি অবকাশ এর আশে পাশের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে কখন যে বিকাল হয়েছে বলতে গেলে তা টেরই পাইনি আমরা। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে রাত হবে ভেবে শংকিত হলাম। রিকসা চালক আমাদেরকে অভয় দিয়ে পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে দ্রুত রিকসার প্যাডেল ঘুরাতে লাগলো। গজনি অবকাশের একরাশ স্মৃতি বুকে নিয়ে আমরা সেখান থেকে ফিরে এলাম। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট তারিখ: ২৩// ০৮// ২০২৩.