পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট——মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনাবলি -১০

/ – এবাদত আলী
(১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। ভোর প্রায় ৫টা ৫০ মিনিট। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘ তোরা কি চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’’ মেজর হুদা বলে ‘আামি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন ‘‘ তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কি করেছিস? উত্তরে হুদা বলে ‘ স্যার কামাল তার জায়গায়ই আছে আর আপনি তুই তুই করে বলবেননা। আপনি বন্দি, চলুন।’ এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘‘ কি তোদের এত সাহস! পাকিস্তানি আর্মিরা আমকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে কেই আমাকে মারতে পারেনা।’’ )।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর ৫ টা ১৫ মিনিট। ধানমন্ডির আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ করে এক প্লাটুন সৈন্য। পাহারারত পুলিশকে নিরস্ত্র করতে ছোঁড়া হয় গুলি। গুলির শব্দে জেগে ওঠেন সেরনিয়াবাত। ব্যস্ত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করতে। সে সময় দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে ঘাতকরা। ড্রইং রুমে জড়ো করা হয় সবাইকে। তারপর নির্দয়ভাবে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বেবী, ১২ বছরের ছেলে আরিফ, ৪ বছরের নাতি বাবু, (আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর ছেলে) ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে আব্দুল নঈম খান রিন্টু, (আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই), তিন অতিথি এবং ৪ জন কাজের লোককে। কেবল আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে হাসনাত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অপারেশনের দায়িত্বে ছিলো মেজর ফারুক। সে অফিসারদের অপারেশনের পরিকল্পনা জানায়। সিদ্ধান্ত হয় ঔ বাড়িকে ঘিরে দুটি বৃত্ত তৈরি করা হবে। ভেতরের বৃত্তের সদস্যরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করবে। বাইরে থেকে রক্ষীবাহিনী বা ভেতর থেকে সেনাবাহিনীর কোন আক্রমণ এলে তা ঠেকানোর দায়িত্বে থাকবে বাইরের বৃত্তের সদস্যরা। বাইরের বৃত্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর নুর ও মেজর হুদাকে।
এক কোম্পানি সেনাসহ রেডিও স্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউমার্কেট এলাকায় দায়িত্বে ছিলো মেজর শাহরিয়ার। পিলখানায় বিডিআর এর তরফ থেকে কোন ধরনের আক্রমণ হলেও তা প্রতিহত করার দায়িত্ব ওই গ্রুপকে দেওয়া হয়। ২৮ টি ট্যাংক নিয়ে শেরে বাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করার দায়িত্ব নেয় মেজর ফারুক নিজে। সেসব ট্যাংকে গোলা না থাকলেও মেশিনগানে প্রচুর গুলি ছিলো।
আক্রমণে মেজর রশিদ সরাসরি কোন দায়িত্বে ছিলো না। তার দায়িত্ব ছিলো হত্যাকান্ড পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমন্বয় করা।
৩২ নম্বর আক্রমণ: ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা মাত্র বড়ির দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়। ততক্ষণে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে হত্যার খবর জেনে গেছেন বঙ্গবন্ধু। প্রধান গেটেও চলছে হট্টগোল। বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরের বরান্দায় ঘুমিয়েছিলেন দুই গৃহকর্মি মোহাম্মদ সেলিম (আবদুল) ও আব্দুর রহমান শেখ রমা। নিচ তলায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারি এ এফ এম মহিতুল ইসলাম। মহিতুলকে বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে বলেন,‘‘ সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারিরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা। …’’ কিন্তু পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোন সাড়াশব্দ পেলেননা মহিতুল। চেষ্টা করতে থাকেন গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে।
বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব এর আদেশে গৃহকর্মি আব্দুল আর রমা নিচে নেমে ফটকের বাইরে গিয়ে দেখেন, সেনা বাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগুচ্ছে। ভীত সন্ত্রস্ত রমা বাড়ির ভেতরে এসে দেখেন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা বঙ্গবন্ধু নিচ তলায় নামছেন। দেখলেন আতঙ্কিত অবস্থায় ছুটাছুটি করছেন বেগম মুজিব। রমা এবার চলে যান তিন তলায়। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে। ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পরে নিচ তলায় নামেন শেখ কামাল। পিছু পিছু সুলতানা কামাল আসেন দোতালা পর্যন্ত। তিন তলা থেকে আবার দোতালায় নেমে আসেন রমা। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও। জামা-কাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতালা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কক্ষে যান।
বাইরে তখন গোলাগুলি। নিচ তলার অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধু। তাঁর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে মহিতুলের কাছ থেকে রিসিভার টেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘‘ আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব…..।’’ ব্যস, এপর্যন্তই কথা। কথা শেষ হলোনা তার।
জানালার কাঁচ ভেঙে এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে অফিসের দেওয়ালে। এক টুকরো কাঁচে ডান হাতের কনুই জখম হয় মহিতুলের। টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। কাছে টেনে শুইয়ে দেন মহিতুলকেও। এর মধ্যে আব্দুল কে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবী ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ থামলে উঠে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। পাঞ্জাবী ও চশমা পরেন। অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। পাহারায় থাকা পুলিশ ও সেনা সদস্যদের বলেন, ‘‘ এত গুলি হচ্ছে তোমরা কি করছো?’’ এ কথা বলেই উপরে চলে যান বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নামেন। বারান্দায় দাঁড়িয়েই বলেন, ‘ আর্মি আর পুলিশ ভাইরা আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’ শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নুরুল ইসলাম খান।
ঠিক তখনই সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। গেটের ভেতর ঢুকেই তারা হ্যন্ডসআপ বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের ভিতর নিয়ে যান নূরুল ইসলাম খান। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে বলেন আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। মহিদুল ঘাতকদের বলেন, উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আর তখনই বজলুল হুদার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝাঁজরা করে দেয় শেখ কামালের দেহ। প্রাণ হারান তিনি।। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
,তারিখ ১৬ /০৮/২০২৩