// এবাদত আলী
কি শহর কি গ্রামগঞ্জ, আজকাল সবখানেই মশার উৎপাত। অতি ক্ষুদ্র একটি প্রাণি মশা কি ভাবে যে মানুষকে নাজেহাল নাস্তাানাবুদ করে তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। এমন বেহদ্দ বেশরম মশা কখন কোথায় যে হুল ফুটায় তা নিশ্চিত কিছু বলা যায়না। গ্রামাঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে ‘ সতিনের কথা সয়না গায়, মশার কামড় সয়না পায়।’ মশা সুযোগ পেলেই সর্বপ্রথম পা কামড়িয়ে দেয় বা হুল ফুটিয়ে রক্ত চুষে পেট মোটা করে। মশার কামড়ে এক পা আরেক পায়ের সাথে ঘষাঘষি করলে মশা বোঁ বোঁ শব্দে উড়াল দিয়ে পালিয়ে যায়। সারা দিন একটানা খাটুনির পর কোন স্বামী-স্ত্রী যদি রাতের বেলা একই বিছানায় মশারি বিহীন অবস্থায় শয়ন করে নিদ্রা যেতে চায় তো বেয়াকুব বে তমিজ মশা কখনো স্বামীর পায়ে আবার কখনো বা স্ত্রীর পায়ে হুল ফুটায়। হুলের জ্বালায় স্বামীর পায়ের সাথে স্ত্রীর পা গুতাগুতি খায়। রক্ত চোষা মশা তখন শুন্যে ভাসে আর তাচ্ছিল্য ভরে বোঁ বোঁ শব্দ করে উল্ল¬াস করতে থাকে।
মশারি ক্রয় করার সামর্থ যাদের নেই তাদেরকে প্রতি রাতেই মশা হুল ফুটায়। তখন হয়তো বা তারা নিরুপায় হয়ে অতি তা’জিমের সঙ্গে মশক কুলকে বলে, ‘‘ইয়া মশাউন কানা ভনভনাতুন, আনা গারিবুন- ফাকিরুন, মশারি না কেনাতুন’’ হে মশক বৃন্দ, দোহাই তোমাদের! আমাদের কানের কাছে ভনভন করোনা। আমরা এতই গরিব এবং আমাদের হালত এতই ফকিরী যে মশারি ক্রয় করার মত সামর্থ আমাদের নেই।’
কিন্তু মশা এমনি বেপরোয়া মুর্খ প্রাণি যে, তারা কোন ভাষা বুঝেনা এবং বুঝতে চেষ্টাও করেনা। শুধু রক্ত চায়, তাজা রক্ত। মশক কুল সারাদিন চোরা-গুপ্তা হামলা চালিয়ে লাথিগুড়ি খেয়ে কোনমতে মানুষের রক্ত চোষার পর সাঁঝ নামার সঙ্গে সঙ্গে হাউ-মাউ-খাও মানুষের গন্ধ পাও বলে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে। বিছানায় শায়িত মাসুম বাচ্চা মশার কামড়ে কেঁদে কেঁদে ওঠে। পড়ার টেবিলে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ঠেসে ধরে। মশার জ্বালাতন খাবার টেবিলে, নামাজে-মোনাজাতে, মেরাকাবা-মোশাহেদাতে, কোর্ট-কাচারিতে, অফিস-আদালতে, থানা হাজত ও জেল হাজতে, স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, হাসপাতাল-ক্লিনিকে, দোকান-পাট ও অন্যান্য ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে,
ওয়াশ রুমে, ড্রইং রুমে, গদি ঘরে, হেঁসেল ঘর ও গোশালাসহ সর্বত্র বিরাজমান।
স্বামী-স্ত্রীর একান্ত আলাপনের সময় মশা হুল ফুটায়। স্বামীর উপস্থিতিতে স্ত্রীর নরম গালে বেরশিক মশা দ্বিধাহীন চিত্তে হুল ফুটিয়ে রক্ত চুষে নেয়। স্বামী গোবেচারা স্ত্রীর ফুলা গালের পানে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা। নিজের গালে নিজে চড় থাপ্পর খাওয়া যায় তা বলে মশা তাড়াতে গিয়ে স্ত্রীর গালে চড় থাপ্পর দেওয়া যায়না। তাহলে যে লংকাকান্ড বেধে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তুচ্ছাতিতুচ্ছ মশা মারতে তো আর কামান দাগা যায়না। তাই স্ত্রীর গালে মশা অনধিকার চর্চা করলে সহিঞ্চুতা না দেখিয়ে উপায় কি। তেমনি প্রেমিকের উপস্থিতিতে প্রেমিকার গালে, ভায়ের উপ্িস্থতিতে আদরের বোনকে, মামার উপস্থিতিতে ভাগ্নিকে, এবং মা-বাবার সামনে নিজের সন্তানকে মশা হুল ফুটিয়ে রক্ত চুষে নিলে কিছুই করার জো থাকেনা। মানব দেহে মশা নামক প্রাণি হুল ফুটিয়ে চলে যায় বটে অতঃপর শুরু হয় চুলকানি। চুলকানি একবার শুরু হলে আর থামতে চায়না। দাদা চুলকায়, দাদি চুলকায়, নাতি নাতনি সকলেই মশার কামড়ে চুলকাতে থাকে।
মশা প্রাণিটি অতি দুর্ধর্ষ। নমরূদের মত একজন প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির মস্তিস্কের কোষে ঢুকে তাকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল। মশার জ্বালাতন থেকে রক্ষা পেতে নিজ কর্মচারির মুগুরের আঘাতে তাকে জীবন খোয়াতে হয়েছিলো।
বেহুলা লখিনদরের পৌরানিক কাহিনীতেও মশার ভুমিকা উল্লেখযোগ্য। চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিনদরকে মনসা দেবীর কবল হতে রক্ষা করতে লোহার বাসর ঘর তৈরি করা হয। ঐ ঘরে বেহুলা লখিনদরকে রাখা হলে ঘুমন্ত লখিনদরের পায়ে মশা হুল ফুটিয়ে দেওয়ায় ফণাধারি সর্পের (মনসা দেবী) গায়ে পায়ের আঘাত লাগলে লখিনদরকে দংশন করে। বিষের জ্বালায় লখিনদর ছটফট করতে থাকলে দুষ্ট দুরাচার মশা মনসাদেবীর সঙ্গে ছোট্ট ছিদ্র পথ ধরে বোঁ বোঁ শব্দে নির্বিঘেœ কেটে পড়ে।
মশা এমনি কড়িৎকর্মা প্রাণি যে, এক চিলতে জায়গা পেলেই দৌড়ে পালাতে সক্ষম। এক নিমিষে উড়ে একশ গজ দুরে যেতে এবং ইচ্ছা করলে প্রায় তিরিশ মিটার উপরে উঠতে পারে।
বসত বাড়ির আশপাশের জলাশয়, ফুলের টব, ডাবের খোসা কিংবা তরিতরকারির ছোবড়ার উপর সামান্য পরিমাণ পানি জমে থাকলে স্ত্রী জাতীয় মশা ডিম পেড়ে অবাধে বংশ বিস্তার করতে পারে। ডিম পাড়ার পর শকুনের মত দেড় মাস এবং মুরগির মত একুশ দিন ধরে ডিমের উপর বসে তা দিতে হয়না। মশার ইনকিউবেটর মেশিন এতই শক্তিশালী যে, মশা ডিম পাড়ার কিছু সময় পরেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মশার বাচ্চা কিউলেক্স, এনোফিলিস কিংবা এডিস যে জাতেরই হোকনা কেন ডিমের খোলস থেকে বের হবার কিছু সময় পরেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রাক্ষসের মত হাউ মাউ মানুষের গন্ধ পাও বলে মানুষসহ গরু-মহিষ ও অন্যান্য জন্তু জানোয়ারদের খোঁজ করতে থাকে। মশার যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে প্রায় সোয়া দুশ বছর আগে ভারতের প্রখ্যাত কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, “রাতে মশা দিনে মাছি/ এই তাড়িয়ে কলকাতায় আছি।”
মশার উপদ্রব বা জ্বালাতন সম্পর্কে খুব বেশি করে ‘বয়ান’ করার দরকার পড়েনা। কারণ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই মশক কুলের যন্ত্রনা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ক্ষুদ্রতম প্রাণি মশার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ে। মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার, জাপানিজ এনসেফালাইটিস, চিকুনগনিয়া প্রভৃতি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কিউলেক্স প্রজাতির মশা এবং কিউলেক্স কুইনকুইফেসিয়েটাস মশা ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ রোগ সৃষ্টি কারী পরজীবী কৃমির বাহক। পৃথিবিীব্যাপী মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। রাজধানী ঢাকার মশার মধ্যে ৯০ ভাগই হচ্ছে এডিস মশা। এডিস মশার আক্রমণের ফলে ইদানিং রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ জেলাতেই ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। পাবনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সিনসা পত্রিকায় গত ১১ জুলাই -২০২৩ এর ০৫তম সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদ হতে জানা যায় এ পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে ১৩ হাজার ৮ শ ৪৩ জন ডেঙ্গু রোগি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে (১০ জুলাই পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৬ জন রোগি।) ডেঙ্গু রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে জন সচেতনতা অতিব জরুরি। মশার জ্বালাতন থেকে রক্ষা পেতে চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ও লার্ভা সনাক্তে ড্রোন ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে। যা নাকি সুধি মহলে হাসির খোরাক জুগিয়েছে। মশা নিধনের জন্য রাজধানী ঢাকাসহ সিটি কর্পোরেশনগুলো ভাইকেল মাউনটেড বা কামান ব্যবহার করে থাকে। এতে কিছুটা হলেও মশা দমন হয়। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জের মশা মারতে কেউ কখনো কামান দেগেছে একথা শোনা যায়না। মশার জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তাই এক গ্রাম্য কবি লিখেছেন-‘‘ ডাঁশা ডাঁশা মশারে/ (তুই) করিসনে ‘ও’ দশারে/ মশার জ্বালায় পরাণ যায়/ এখন আমি পালাবো কোথায়?’’
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।