মাজহার মান্নান , কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
”হে প্রিয় গায়ক সুরের যাদুকর
তোমার গানের পাগল বাংলার প্রতিটি ঘর
তোমার গান শুনে কেটেছে মোদের বাল্যকাল
সিনেমা গানের তুমি এক মহা দিকপাল।”
৬ জুলাই ২০২০ মরণব্যধি ক্যান্সারের কাছে হার মেনেছিলেন বাংলা চলচিত্র গানের সম্রাট প্রিয় এন্ড্রুকেশর। তিন বছর হয়ে গেল তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার গান আমাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। মনের অজান্তেই গুণগুণ করে গেয়ে উঠি তার গান। তার ব্যতিক্রমী কন্ঠের জন্য তিনি কিংবদন্তি শিল্পীতে পরিনত হয়েছিলেন। কিন্তু এই মহান শিল্পীকে খুব একটা স্মরণ করতে দেখা যায় না। বছরে একবার পত্রিকায় সামান্য পরিসরে তাকে স্মরণ করা হয়। কিন্তু এমন একজন গায়ক কি বাংলায় আর তৈরি হবে? তিনি চলে গেলেও তাকে যেন স্মরণ করতে না ভুলি। এন্ড্রুকিশোর, যাকে আমরা গানের রাজা বলেই জানি। বাংলাদেশের এমন কোন মানুষ নেই যে এন্ড্রুকিশোরের গান শোনেন নি। সুরের জাদুকর এই মানুষটি ছিলেন মূলত প্রচার বিমুখ একজন শিল্পী। কিন্তু তার দরাজ কণ্ঠের গান তাকে দেশ বিদেশে পরিচিত করে তুলেছে। বাংলা সিনেমা গানের পথিকৃৎ এন্ড্রুকিশোর অসংখ্য গান গেয়েছেন যেগুলোর বেশিরভাগ সুপারহিট হয়েছে। প্লেব্যাক গায়ক হিসাবে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তিনি এমন একজন গায়ক ছিলেন যিনি সকল ধরণের গানে মুন্সিয়ানা দেখাতে পারতেন। তার কণ্ঠে মুগ্ধ হোন নি এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। একাগ্রচিত্তে নিরবিচ্ছিন্নভাবে গান গেয়ে গেছেন তিনি। তার কণ্ঠের মাঝে একটি ভিন্নতা ছিল। বাংলা চলচিত্রে পুরুষ কণ্ঠ বলতে এন্ড্রুকিশোরকেই বুঝাতো। যত কঠিনই গানই হোক তিনি সেটাতে দক্ষতার সাথে সুর তুলতে পারতেন। তিনি বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশের বহু চলচিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এবং ধারাবাহিকভাবে জনপ্রিয় সব গান উপহার দিয়েছেন আর এজন্য তাকে প্লেব্যাক সম্রাট হিসাবে গন্য করা হয়। কিশোর আর তরুনদের চোখের মণি ছিলেন এন্ড্রুকিশোর। আশি এবং নব্বই এর দশকে তার গান মানুষকে মাতিয়ে রাখতো। তখনতো প্রযুক্তি ততোটা উন্নত হয়নি। রেডিও ছিল বিনোদনের প্রধান উৎস। সবার বাড়িতেই রেডিও থাকতো। আর রেডিওতে প্রচারিত হত অনুরোধের গানের আসর। এই আসার শোনার জন্য সারা দেশের তরুন কিশোররা অপেক্ষা করতো। এন্ড্রুকিশোর, রুনা লায়লা আর সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গান শোনার নেশা ছিল তীব্র। পড়ার টেবিলে একটি ছোট রেডিও তখন সবারই থাকতো। সময় পেলেই রেডিওতে গান শুনতো আশি ও নব্বই দশকের কিশোর যুবকেরা। এন্ড্রুকিশোর এমন একজন উচ্চমাপের গায়ক ছিলেন যার ছিল অনন্য গায়কী দক্ষতা এবং যিনি শ্রোতাদের মাঝে একটি বিশেষ রুচিবোধ তৈরি করতে পেরেছিলেন।
একজন শিল্পী শুধু একজন গায়ক নন। তিনি কিশোর যুবকদের পথ প্রদর্শক হিসাবেও কাজ করেন। বাংলা গানের মাঝে যে কত মাধুর্য লুকিয়ে আছে এন্ড্রুকিশোর সেটা প্রমাণ করেছিলেন। সুন্দর, সাবলীল এবং সুস্থ ধারার গান গেয়ে তিনি একটি উন্নত রুচি তৈরি করেছিলেন শ্রোতাদের মাঝে। রাজধানী থেকে শত শত মাইল দুরের একটি অঞ্চলে থেকে তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। রাজশাহীতে জন্ম নেয়া এই শিল্পীর উঠে আসার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। তিলে তিলে কঠোর সাধনা আর পরিশ্রম করে তাকে অনন্য উচ্চতায় পৌছাতে হয়েছে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- মর্ণিং সোজ দ্যা ডে। অর্থাৎ দিনের শুরু দেখলেই বুঝা যায় দিনটি কেমন যাবে। এই প্রবাদটির মিল দেখতে পাই আমরা এন্ড্রুকিশোরের জীবনে। খুব ছোট থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তার গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। শিশুকাল থেকেই সঙ্গীতের তালিম নেয়া শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর রাজশাহী বেতারে এন্ড্রুকিশোর নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, লোক সঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেছেন এবং তার সুরেলা কণ্ঠের কারণে অতি অল্প সময়ে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন। ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর তিনি রাজশাহীতে জন্মগ্রহন করেন। সেখানেই তার বেড়ে উঠা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। আর অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তিনি নিজেকে সঙ্গীত জগতে সম্পৃক্ত রেখে ধীরে ধীরে আগাতে থাকেন। ১৯৭৭ সালে মেইল ট্রেন চলচিত্রে প্লেব্যাক করার মাধ্যমে তিনি পরিচিত হতে শুরু করেন। এক এক করে বেশ কিছু গান হৃদয়গ্রাহী গান তিনি উপহার দিতে সক্ষম হন। এরপর থেকে তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। বাংলা চলচিত্র পুরুষ কণ্ঠের জন্য তার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কেননা তার বিকল্প কোন পুরুষ কণ্ঠ খুঁজে পাওয়া তখন প্রায় অসম্ভব ছিল। তার গানগুলি মানুষের মুখে মুখে শোনা যেতো। তার গানের কারনে বহু বাংলা সিনেমা সুপারহিট হয়েছে। তিনি পনের হাজারের উপরে সিনেমার গান গেয়েছেন যা বাংলাদেশে আর কোন পুরুষ শিল্পী পারে নি। আধুনিক বাংলা গানকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন কিশোর। ” জীবনের গল্প বাকি আছে অল্প, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, আমার সারা দেহ খেয়োগো মাটি, বাবার মুখে প্রথম যেদিন, আমার বুকের মধ্য খানে” ইত্যাদি কালজয়ী গান সহ আরো বহু জনপ্রিয় গান তিনি গেয়েছেন। তার কণ্ঠের দূত্যি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ বিদেশের শ্রোতাদের মাঝে। জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কার পেয়েছেন আট বার। অন্যান্য পুরষ্কারতো আছেই। এন্ড্রুকিশোরের গানগুলি আমরা মূলত রেডিওতে শুনতাম। টিভিতে তাকে খুব একটা দেখা যেত না। রেডিওতে শুধু তার কণ্ঠটি শুনতে পেতাম। কিন্তু প্রিয় গায়ককেতো দেখারও মন চাইতো। হানিফ সংকেতের ইত্যাদির কল্যাণে আমরা বিটিভিতে এন্ড্রুকিশোরকে দেখতে পেয়েছিলাম। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এন্ড্রুকিশোরের গান না শুনে ঘুমোতে গিয়েছি এমন রাতের কথা মনে পড়ে না। আমাদের কাছে ছিলেন তিনি স্বপ্নের একজন গায়ক। বেঁচে থাকলে তিনি আরো বহু কালজয়ী গান তিনি উপহার দিতে পারতেন। কিন্তু মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে অকালেই ঝরে গেলো তার প্রাণ। সিঙ্গাপুরের দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু ক্যান্সার তাকে বাঁচতে দেয়নি। ২০২০ সালের ৬ জুলাই মারা যান কিশোর। এন্ড্রুকিশোর শুধু গায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তার জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে তখন দেশের বাইরে কাজ করার অনেক সুযোগ আর অফার তিনি পেয়েছেন যা তিনি সহজেই লুফে নিতে পারতেন। কিন্তু কিশোর তা করেন নি। তিনি কোন প্রাপ্তির পিছনে অহেতুক ছুটাছুটি করেন নি।বরঞ্চ প্রাপ্তি তার হাতে এসে ধরা দিয়েছে। গানের মৌলিককত্বকে তিনি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতেন। সুর, তাল, লয়, ভাব, ছন্দ এবং অভিব্যক্তি সব কিছু মিলিয়ে তিনি একটি গানকে প্রাণবন্ত করে তুলতেন।
আমরা আসলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না। একবার কলকাতায় একটি প্রোগ্রামে যোগদান করেছিলাম। সেখানে অনেকেই আমার কাছে এন্ড্রুকিশোর সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম কিশোর এদের মনেও ঠাঁই করে নিয়েছে। কিশোরের জীবনী থেকে জানা যায় তিনি নিজের দেশ এবং মাটিকে খুব ভালোবাসতেন। তাই তিনি হাজারটি সুযোগ পেয়েও দেশ ছাড়েন নি। দেশের চলচিত্রে গান গেয়েই জীবন পার করেছেন। তার দেশপ্রেমের আরেকটি বড় প্রমান পাওয়া যায়।তিনি যখন বুঝতে পারলেন এ জগতে আর মাত্র কয়েক দিনের অতিথি তিনি তখন দেরি না দ্রুত সিঙ্গাপুর ত্যাগ করে দেশে চলে এলেন মাটির টানে। তিনি পরিবারকে বলেছিলেন তিনি দেশের মাটিতে মরতে চান। তিনি ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকায় নেমেই তিনি তার জন্মস্থান রাজশাহীতে ছুঁটে গেলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার হাতে সময় খুব কম। তাই তিনি তার জন্মস্থানে ছুঁটে গেলেন। একজন এন্ড্রুকিশোরকে হারালাম আমরা। বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হল সঙ্গীত জগতে। এমনিতেই বাংলা সিনেমার সেই উজ্বল দিন গুলি মলিন হতে চলছিলো ঠিক সেই কিশোরের বিদায় মরার উপর খাড়ার ঘা। কিশোরের অভাব পূরুণ করার মত শিল্পী বাংলাদেশে আর তৈরি হয়নি। কবে হবে সেটাও কেউ বলতে পারে না। চার দশক গান গেয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে কিশোর যতটা সমৃদ্ধ করেছেন তা আর অন্য কোন শিল্পী পারেন নি। ১৯৬৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৪ বছর তিনি একাধারে বিভিন্ন ধরনের গান গেয়েছেন। মানুষের রুচিতে পরিবর্তন এনেছেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তিনি দুই বাংলার চলচিত্রে প্লেব্যাক করেছেন। ৪২ বছর তিনি বাংলা চলচিত্রের গান গেয়েছেন। বাংলা সিনেমা পাড়াকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করে তুলেছেন। কিন্তু একজন তুমুল জনপ্রিয় গায়ক হওয়া সত্বেও তিনি অনেক আক্ষেপ আর দুঃখ নিয়ে মারা গেছেন। তিনি অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তার ভাষ্য অনেক স্বপ্নই পূরুণ করতে পারেন নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার আরো অনেক বেশি মর্যাদা পাওয়ার কথা ছিলো। হয়তো তিনি তা পান নি। তাতে কি? শ্রোতারাতো তাকে ভুলে নাই এবং ভুলবেনা। তবে কিশোরের অবদানের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্র এখনো অনেক কিছু করতে পারে। ভারতে ভুপেন হাজারিকার নামে ৯ কিলোমিটার একটি দীর্ঘ সেতু রয়েছে। অন্যান্য শিল্পীর নামেও অনেক স্থাপনা আছে। আমাদের এন্ড্রুকিশোরের জন্যও আমরা কিছু করতে পারি। শুধু দরকার সদিচ্ছা। উন্নয়নের রূপকার বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশের জন্য অনেক ভাল কিছু করছেন। আমাদের এই প্রিয় শিল্পীর জন্য তিনি কিছু করবেন এটা আমরা বিশ্বাস করি। কাব্যিক ভাষায় বলতে হয়–
বাংলা গানের মহান গায়ক
এন্ড্রুকিশোর তুমি
দরাজ গলার সুরেলা কণ্ঠে
ধন্য মাতৃভূমি।