ফেলে আসা দিন গুলো-৪০

//এবাদত আলী //

আমি সাহস সঞ্চয় করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বল্লাম আরে ভাই আমাদেরকে হত্যা করা সেতো সামান্য সময়ের ব্যাপার। তোমরা যদি নাই ছাড়ো গুলি করে দাও। কিন্তু এশার নামাজ পড়ারতো সুযোগ দিবে। নামাজের কথা বলতেই ওরা যেন একটু নরম হলো। বলল একজন একজন করে নামাজ পড়তে পারো। ঠিক আছে হাতের বাঁধন খুলে দাও। কি মনে ভেবে আমাদের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো।ওজু করানোর জন্য রাইফেল তাক করে ধরে শাকোর নিচে নিয়ে ওজুর ব্যবস্থা করে দিলো। আমরা এশা’র নামাজ আদায় করলাম একেক জন একেক জায়গায়। ওরা রাইফেল ধরে আছে। নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে প্রাণ খুলে শেষ মোনাজাত করি। জীবনের শেষ মুহুর্ত এটা। এ চরম লগ্ন। একথা ভোলা যায়না। জীবনের প্রতি যে কত মায়া তা মৃত্যুর মুখোমুখি না হলে কিছুতেই বুঝা সম্ভব নয়। বার বার আমার পরিবার বিশেষ করে নবজাত শিশুর মুখ আমার মানসপটে ভেসে ওঠে । তখনকার ভাবনা: আমার মৃত্যু হবে, রাজাকার কিংবা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। ওরা হয়তো গুলি করে মারবে নয়তো ব্যায়োনেটের আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করবে। হত্যা করার পর সে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেবে কিংবা যেখানে সেখানে ফেলে দিবে। হয়তো শিয়াল কুকুর কিংবা শকুনেরা তা তৃপ্তি সহকারে উদর পুর্তি ক করবে। আমাদের মৃত্যু কেমন অবস্থায় হবে তা কেউ জানতে বা অনুমান করতে পারবেনা। মা বাবা স্ত্রী পরিজন বুক চাপড়ে কেঁদে কেঁদে ফিরবে। তবে একথাও ঠিক যে, দেশের সাধারণ মানুষ আমাদের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তখনকার অনুভুতি এমন যে, এ দেশ একদিন স্বাধীন হবে। সেদিন শহীদের কাতারে আমাদের নামও স্বর্নাক্ষরে লিপিবদ্ধ হবে। এ মৃত্যু যে সে মৃত্যু নয়, শহীদি মৃত্যু। নিজের মাতৃভুমি রক্ষার জন্য মৃত্যু, এ মৃত্যু আনন্দের। তাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু জীবনের মায়া বড়ই কঠিন। পরক্ষনেই বাঁচার তাগিদে পথ খুজতে থাকি। মনোহরপুর বড় শাকোর নিচে তখন অথৈ পানি। কলকল রবে স্রােত বেয়ে চলেছে। জোসনার আলো পড়ে নদীর পানি চিক চিক করছে। পাঁচজন রাজাকারের মধ্যে তখন তিনজন জেগে আছে। বাকি দুজন রাইফেল পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজের ওজন যাচাই করার বাসনা মনে জাগে। আচমকা ওদেরকে আঘাত করে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ¯্রেেতর টানে ভাটির দিকে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু আমার ভগ্নিপতিদের কারণে তা সম্ভব নয়। ঠিক এমন সময় পিছন দিক থেকে একটি জিপ গাড়ি এসে ব্রিজের উপর থেমে গেল।
একজন রাজাকার আমাকে পিঠে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করতেই জিপ থেকে একজন আর্মি অফিসার নেমে ঠাওরাও। মত মারডালো বলে চিৎকার করে উঠলো। আমি দাঁড়িয়ে তাঁকে বিনীতভাবে সালাম জানালে তিনি সালামের উত্তর নিলেন এবং ঐ রাজাকারকে বললেন কেয়া বাত? ইয়ে আদমী মুক্তি হায়? তখন রাজাকাররা বললো, স্যার ইয়ে লোগ মুক্তিফৌজ হায়। তখন আর্মি অফিসার বললো, ঠিক হায় ইছকো মত মারডালো। সুবেহ কি ওয়াক্ত হামারা ক্যাম্পমে ভেজ দিয়ো। বাত ঠিক হায়? বলে জিপ নিয়ে ঈশ্বরদীর দিকে চলে গেল। তখন রাজাকাররা ববলাবলি করতে লাগলো হারামজাদা আমাদের হাত থেকে বাঁচলেও সকালে যখন আর্মি ক্যাম্পে যাবে তখন বুঝবে কেমন হালত হয়। ঘন্টা খানেক পর সেই জিপ পুনরায় পাবনা শহরের দিকে চলে গেল।
দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেল। পাবনা থেকে একটি খালি ট্রাক ঈশ্বরদীর দিকে চলে গেল। ঐ ট্রাকে করে ব্রিজ প্রহরারত রাজাকারদেরকে পর্যায়ক্রমে তুলে পাবনা ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। এদিকে রাজাকাররা সকলেই একজন একজন করে ফজরের নামাজ আদায় করলো। আমরা নামাজ আদায় করতে চাইলে সে সুযোগ আর দেওয়া হলোনা। ফিরতি ট্রাক এসে গেল। রাজাকাররা আমাদেরকে ট্রাকে উঠতে বললো। এমনসময় ব্রিজের পাশের বাড়ির শমসের মওলানা ও তার প্রতিবেশি শাহজাহান আলী বাড়ির বাইরে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে শমসের মওলানাকে ঘটনা খুলে বলি। তিনি তখন রাজাকারদেরকে বলেন, তোমরা এদেরকে কেন নিয়ে যাচ্ছ? রাজাকাররা তাঁর পুর্ব পরিচিত, তাই বলে যে, এরাতো মুক্তিবাহিনী, তাই নিয়ে যাচ্ছি। তখন তিনি দৌড়ে গিয়ে ট্রাকের সামনের সিটে বসা আর্মি অফিসারকে বলেন যে, এরা আমার খালাতো ভাই। এদেরকে কেন নিয়ে যা্েছন। প্রতিদিন সকালে রাজাকার উঠিয়ে নেওয়ার সুবাদে আর্মি অফিসার তার পরিচিত তাই তিনি বেঁকে বসেন এরা আমার ভাই। এদেরকে ছেড়ে দেন। আর্মি অফিসার উর্দুতে তার সাথে অনেক কথা কাটাকাটি করে। তিনিও নাছোড় বান্দা। তিনি এবং শাহজাহান দু’জনেই বলেন যে, এরা আমাদের আত্মীয়। এরা নির্দোষ। তাদের এহেন পীড়াপিড়িতে রাজাকাররাও অনেকটা নম্র হয়। আমি তখন মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। যাক, এক পর্যায়ে তারা আমাদেরকে ছেড়ে দিল।
নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ছাড়া পাবার পর আল্লাহর শুকর গোজার করলাম। শমসের মওলানা ও শাহজাহান ভাই আমাদের কাছে আরজি দিলেন যেন মনোহরপুরের ব্রিজ বা বড় শাকোর যেন কোন ক্ষতি না হয়।
আমরা তাতে সম্মত হই। এরপর মুক্তি বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প বক্তারপুরে গিয়ে কমান্ডারের নিকট বিস্তারিত রিপোর্ট করলাম এবং সেই সঙ্গে আমাদের দেয় ওয়াদার কথাও তাকে জানাই। তিনি বলেন, আপনার ওয়াদার কারণে আমরা সেখানে কোন অপারেশন চালাবোনা।
এদিকে বর্ষার পানি কমতে শুরু করে। পথঘাটে তখন পায়ে হেঁটেই চলাচল করা য়ায়।
মুলত আমাদের কাজ ছিলো দেশের অভ্যন্তরে যাতে রাজাকার, আলবদর, আল শামস মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে আর দিকে নজর রাখা। সেই সঙ্গে সুযোগ পেলে পাকিস্তানি আর্মিদের উপর আঘাত হানা বা তাদেরকে বিভিন্নভাবে কাবু করা। (চলবে…)

(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।