ফেলে আসা দিন গুলো-৩৯

// এবাদত আলী //

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমরা সেই রাতে ঈশ্বরদী থানার বক্তারপুর মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছলাম। এসময় উপর থেকে নির্দেশ আসে পাবনা ঈশ্বরদী রোডের কয়েকটি ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার। এজন্য প্রয়োজন রেকি করা। কমান্ডার ওয়াসেফ আলী আমাকে দায়িত্ব দিলেন মনোহরপুর ব্রিজ অর্থাৎ মনোহরপুর বড়ো শাকো উড়িয়ে দিতে গেলে কোন খানে মাইন সেট করতে হবে, মুক্তিযোদ্ধারা কোন কোন পজিশনে থাকবে ইত্যাদি বিষয়ে পুর্নাঙ্গ একটি নকশা তৈরি করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন পুরা বর্ষাকাল। চারদিকে অথৈ পানি। তাই সকাল বেলা আমাকে দাপুনিয়া পর্যন্ত ডিঙি নৌকাতে করে পাঠানো হলো। রেকি করতে হলে প্রথমে আমাকে বাড়ি যেতে হবে। আমি দাপুনিয়া হতে ছয়ঘরিয়ার দিকে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম। ভেবেছিলাম হোটরা গ্রাম হয়ে শুকনো পথ ধরে বাড়ি পৌঁছতে পারবো। কিন্তু কিছুদুর গিয়ে শুনতে পেলাম যে, হোটরা গ্রামের গোকুল বিশ্বাসকে রাতের বেলা নকশালেরা গুলি করে হত্যা করেছে। সুতরাং ঐ গ্রাম দিয়ে আমার যাওয়া কোনমতেই ঠিক হবেনা। তাই আরো উত্তর দিকে অর্থাৎ তবলপুর গ্রাম সোজাসুজি আমি রওনা হলাম।
কিন্তু কিছুদুর যাবার পরই শুধু পানি আর পানি। কোথাও হাঁটু পানি কোথাও কোমর পানি আবার কোথাও গলা পানি। আমি নিরুপায় হয়ে পানির মধ্য দিয়েই পথ চলা অব্যাহত রাখলাম। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। যেস্থান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যেতে হলেও পানি। কি আর করা একটি বাড়িতে উঠে কিছু সময় জিরিয়ে নিলাম। সেখান থেকে বহু কষ্টে বাড়ি পৌঁছলাম। কিন্তু আমার বাড়ি পৌঁছানো ঠিক হলোনা। কারণ তখন নকশালেরা গ্রাম ছেয়ে ফেলেছে। যারা আমার বন্ধু বান্ধব, যারা আমার নিকটতম ব্যক্তি তারা প্রায় সকলেই নকশালের দলে মিশে গেছে। আমার জীবনের নিরাপত্তা আর আমার বাড়িতে নেই। কি আর করা এসে যখন পড়েছি তখন যে কোন পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। খুব সাবধানেই থাকতে হবে। আবার বেশি দেরিও করা যাবেনা। রেকি সমাপ্ত করে কমান্ডারের নিকট রিপোর্ট দিতে হবে।
সুযোগ বুঝে বিকালের দিকে মনোহরপুর রওনা হলাম। মনোহরপুর ব্রিজ লোকে যার নাম বলে বড়ো শাকো। সেই বড়ো শাকো মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার রেকি করতে আমি যখন রওনা হয়েছি আমার ছোট ভগ্নিপতি বলে আমি আপনার সঙ্গে মনোহরপুর যাবো। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন শাহজাদপুরে যাবো। এদিকে বাড়িতে থাকা ওর মোটেই নিরাপদ নয় তাই ওকেও সঙ্গে নিলাম। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য তাকে জানতে বা বুঝতে দিলামনা।
তখন এমনি একটা সময় যে পাকিস্তানি সৈন্যরা বর্ডার এলাকা এবং দেশের অভ্যন্তরে সর্বক্ষেত্রেই মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছিলো। তাই বড় বড় ব্রিজ ও উল্লেখযোগ্য স্থাপনাসমুহ রক্ষা করার জন্য সেসকল স্থানে রাজাকারদের দ্বারা পাহারার ব্যবস্থা করে। মনোহরপুর বড় শাকোতেও তখন ৫ জন রাজাকার পাহারায় ছিলো।
মনোহরপুর বড় শাকোর পুর্ব পাশেই আমার আপন খালাতো বোনের বাড়ি। আমরা সেখানে গিয়ে উঠলাম। অনেকদিন পর বোনের বাড়ি যাওয়ায় বোন ও ভগ্নিপতি দারুন খুশি। আমাদের জন্য একটি তাগড়া মোরগ জবাই করা হলো। আমার বোন আমাদের আপ্যায়নের জন্য চাউলের আটার রুটি তৈরি করলো। মাগরিবের নামাজ পড়ার পরপরই আমরা খেতে বসলাম। রাজাকার যারা ব্রিজ পাহারায় ছিলো তারা যেভাবেই হোক ততক্ষণে আমাদের অবস্থান জেনে গেছে। আমাদের কাছে একটি ছোট রেডিও ছিলো তাও জেনে গেছে। দুজন রাজাকার এসে বাহানা করলো যে আজ প্রেসিডেন্টের ভাষণ আছে তাই রেডিও সঙ্গে নিয়ে আমাদের সাথে চলেন। আমরা বললাম খাওয়া শেষ হোক তারপর যাওয়া যাবে। আর যদি প্রেসিডেন্টের ভাষণ শুনতে চান তবে রেডিওটা নিয়ে যান। একজন সঙ্গে সঙ্গে বল্লো শালা ওতো পকোর পকোর করে ক্যানরে আমরা আসপের কচ্ছি আসেন ওতো কথা কেন?
আমি তৎক্ষনাৎ পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম, কিন্তু তাতে ফলাফল শুভ হবেনা। ওরা আমার বোনের বাড়ি ঘর জালিয়ে দেবে কিংবা গুলি করে সকলকে হত্যা করবে। তাই ওদের কথা মেনে নিয়ে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আমাদেরকে ওদের সঙ্গে যেতেই হলো। আমি, আমার আপন ভগ্নিপতি মোকবুল আর খালাতো ভগ্নিপতিকে ওরা নিয়ে গেল। আমরা শাকোর উপর পৌঁছা মাত্র আমাদের হাত পীঠমোড়া করে বেঁধে ফেলল। আমরা এর জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলামনা।
রাজাকারদের মধ্যে আমার পরিচিত ছিলো তিনজন। সেকারনে তাদের কাছে অনুরোধ জানালাম আমাদেরকে ছেড়ে দিবার জন্য। বুলবন রাজাকার বলে শালা তোমাকে আমরা হাড়ে হাড়ে চিনি। তুমি ছিলে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র ও ছাত্র লীগের বড় নেতা। তুমিইতো শালা মনোহরপুর টাওয়ার ধংসের নেতৃত্ব দিয়েছিলে। আমি সাহস সঞ্চয় করে বলি তোমরা তো আমার পরিচিত আমার সম্পর্কে তোমরা অনেক কিছুই জানো। আমাদেরকে খামাখা বেইজ্জতি করছো তোমরা। অপরিচিত একজন রাজাকার বলে শালা ওতো কথা বলতেছে ক্যান কাসেম ভাই। গোটা দুই লাত্থি কষে দেননা ক্যা উয়ের পাছার পর। তাহলি সব ঠিক হয়ে যাবিনি। লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু উপায় কি। অপরজন ছুটে এসে ৩০৩ রাইফেলের নল আমার কন্ঠনালীর সঙ্গে ঠেসে ধরলো। তখন মনে হলো জোড়া পায়ে ওর মুখের উপর একটা লাথি কষে দেই। আমি হিসাব কষে দেখলাম আমি ইচ্ছা করলে ৫জন রাজাকারকেই কুপকাত করে দিতে পারি। কিন্তু আমার ভগ্নিপতিদেরতো আর ওরা জীবিত রাখবেনা। তাই মুখ বুঁজে সব কিছুই হজম করতে লাগলাম।আমি সাহস সঞ্চয় করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম আরে ভাই আমাদেরকে হত্যা করা সেতো সামান্য সময়ের ব্যাপার। তোমরা যদি নাই ছাড়ো গুলি করে দাও। কিন্তু এশার নামাজ পড়ারতো সুযোগ দিবে। নামাজের কথা বলতেই ওরা যেন একটু নরম হলো। বল্লো একজন একজন করে নামাজ পড়তে পারো। ঠিক আছে হাতের বাঁধন খুলে দাও। কি মনে ভেবে আমাদের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো। ওজু করানোর জন্য রাইফেল তাক করে ধরে শাকোর নিচে নিয়ে ওজুর ব্যবস্থা করে দিলো। আমরা এশা’র নামাজ আদায় করলাম একেক জন একেক জায়গায়। ওরা আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে রাখলো। (চলবে…)
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।