ফেলে আসা দিন গুলো-৩৭

// এবাদত আলী

পাকিস্তানি আর্মিদের ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটানোর পর ফজরের নামাজ পড়েই আবার
রওনা। সকালের নাস্তাও করা হলোনা। আবার পায়ে হাঁটা শুরু। আমার স্ত্রীর পা ফুলে গেছে। তার পেট নাকি ব্যথা ব্যথা করছে। আমরা সকলেই আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম যেন ভালো ভাবে পোতাজিয়ায় গিয়ে পৌঁছতে পারি। একদন্ত থেকে গরু মহিষের গাড়ি ভাড়া করার জন্য বহু চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কোন গাড়োয়ানই দুরে যেতে চাইলনা। যেতে না চাওয়ার আরেকটি কারণ হলো সারা দেশ জুড়ে চলছে বিশৃঙ্খলা। জেলায়, থানায় এমনকি ইউনিয়নে ইউনিয়নে পিস কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতায় মেতে উঠেছে। তারা লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে। পিস কমিটির চেলা চামন্ডরা লোকজনের গরু ছাগল হাঁস মুরগি, কবুতর চেয়ে নিয়ে প্রকাশ্যে ভুরিভোজ করছে। কোন কোন এলাকায় গরু মহিষ জোর করে নিয়ে জবাই করে নিজেদের উদর পুর্তি করছে। হয়তো সে কারণেই গরু মহিষের মালিকেরা ভাড়ায় যেতে রাজি হয়না।
কি আর করা পথে যখন বেরিয়েছি তখন গন্তব্যে তো পৌঁছতেই হবে সে যত কষ্টই হোকনা কেন। আমরা হেঁটে চলেছি যেন অজানার পথে। অনন্তের যাত্রাপথের পথিক আমরা চার জন। আমার শশুর ও জেঠা শশুর একটু আগে, আমি আর আমার স্ত্রী একটু পিছনে। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই ঘোর বিপদের মধ্যে। একমাত্র আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর মুখে কোন ভাষা বের হচ্ছেনা। আমরা যেন সকলেই বোবা হয়ে গেছি। মাঝে মধ্যে কথা হয় দুএকজন পথচারির সঙ্গে। আমরা কোন পথে পোতাজিয়া যাবো। গ্রামের কোন কোন মেয়ে মানুষ আমার স্ত্রীকে একটু জিরিয়ে নিতে বলেছে। কেউ বা মুড়ি আর গুড় খেতে দিয়েছে। কেই আবার মুখ টিপে টিপে হেঁসেছে ।
কেউ কেউ বলেছে পোয়াতি মানুষকে নিয়ে আপনারা পথে বের না হলেই ভালো করতেন। এম অনেক পরামর্শ আমাদেরকে দেয়া হলো। বাঙালি পরামর্শ দিতে উস্তাদ। সে যে কোন বিষয়েই হোকনা কেন। কারো কথা ভালো লাগে কারো কথা বিষের মত মনে হয়। আসলে যে যখন বিপদে পড়ে সেই তখন বুঝতে পারে বিপদের কি জ্বালা।
এমনিভাবে যেতে যেতে আমরা জলকা-মানানগাঁ নামক স্থানে পৌঁছলাম। কিন্তু এরপর আর আমাদের পক্ষে হয়তো কোথাও যাওয়া সম্ভব হবেনা। আমার স্ত্রী মাহমুদা জানালো তার পক্ষে আর একপাও হাঁটা সম্ভব নয়। তার পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। দারুন ব্যাথা। সে তলপেট ধরে মাঠের মধ্যেই বসে পড়লো। আমরা দারুন চিন্তিত। এখানে যদি তার প্রসব বেদনা শুরু হয় তাহলে কি উপায় হবে। বিলের মাঝে কাটা জোলা। সেই জোলার পাড়ে আমরা একটা হিজল গাছের নিচে বসে পড়লাম। আমি জোলা থেকে কিছু পানি সংগ্রহ করে এনে ওর চোখে মুখে ছিটিেিয় লিাম। কিছু পানি ওকে খাওয়ালাম এবং আমরাও খেলাম। আমাদের সঙ্গে থাকা চিড়ামুড়ি খাওয়া হলো।
দীর্ঘ সময় পর মাহমুদা বল্লো এখন সে আস্তে আস্তে হাঁটতে পারবে। কিন্তু আসতে হাঁটলেতো চলবেনা। বেলা থাকতে আমাদেরকে ধুলাউড়ি গ্রামে পৌছতে হবে। ধুলাউড়িতে আমার পরিচিত মান্নান ভাই আছে। তিনি খুব ভালো মানুষ। চাকুরির সুবাদে তার সাথে আমার পরিচয়। একই দিনে আমার এবং তার জামাই আবদুস সামাদের চাকুরি হয়। জামাইকে সঙ্গে নিয়ে পাবনা তাড়াশ হাউজে জয়েন্ট ডিসির অফিসে যোগদান পত্র দিতে গিয়ে পরিচয় ঘটে।
সামান্য বেলা থাকতে আমরা খোঁড়াতে খোঁড়াতে মান্নান ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। মান্নানের মেয়ে এবং স্ত্রী আমার পুর্ব পরিচিত সেই কারনে তারা আমার স্ত্রীকে পেয়ে দারুন খুশি। আমি মান্নান ভাইকে একটি গরু- মহিষের গাড়ি ভাড়া করে দিতে বললাম। আমরা এই রাতেই পোতাজিয়া চলে যাবো। মান্নান ভাই বল্লেন সব কথা শনবো আগে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা পানি খান। আমাদের থাকার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করা হলো। আমার স্ত্রীকে মায়ের ¯েœহে তারা আগলে রাখলেন। সামাদের স্ত্রী তেল গরম করে মাহমুদার পায়ে সেক দিলেন। রাতের বেলা খাবার খেয়ে আমরা শুতে যাবো এমন সময় মান্নান ভাই জানালেন এক দুশ্চিন্তার কথা। তিনি আমাকে বাড়িতে না থাকার পরামর্শ দিয়ে পাশের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। কারণ তার বড় ভাই পিস কমিটির মেম্বর। সে যদি জানতে পারে তাহলে আমাকে মিলিটারির হাতে তুলে দিতে পারে। তিনি রাতেই একটি মহিষের গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলেন।
সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোর হলো যেন একযুগ পরে। খুব ভোরে অর্থাৎ বেলা উঠবার আগেই আমাদেরকে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হলো। হতাশা উৎকন্ঠা আর ভীষণ ভয়ের মাঝ দিয়ে আমাদের মহিয়ের গাড়ি পোতাজিয়ার পথে রওনা হলো।
ধুলাউড়ি থেকে নরজান, ডেমরা, নাগডেমরা, শিলংদা, চরাচিথুলিয়া হয়ে বড়াল নদীর দক্ষিণ পাড় ধরে আমাদের মহিষের গাড়ি ধীর গতিতে চলতে লাগলো। পথচারিরা জিজ্ঞাসা করে আমরা কারা কোথা থেকে কোথা যাচ্ছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি সংক্ষিপ্ত জবাব দেই আর মনে মনে আল্লাহর নাম জপি। যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়? এমনিভাবে যেতে যেত একসময় রাউতারা ঘাট বরাবর পৌঁছানো হলো। ধলাই নদীর ঘাট। এই খেয়া ঘাট পার হলেই রাউতারা গ্রাম। আর রাউতারা হতে পোতাজিয়ার দুরত্ব মাইল খানেক হলেও তা আমাদের কাছে যৎসামান্য পথ। মহিয়েষর গাড়োয়ানকে কুড়ি টাকা দেওয়া হলো। আমরা খেয়া নৌকায় চড়ে নদী পার হয়ে বাকি পথটুকু পায়ে হেঁটে পোতাজিয়া শশুর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। আমার ছোট বোন রহিমার স্বামী মকবুল হোসেন সেসময় শাহজাদপুরের খুকনি তহশিল অফিসে সহকারি তহশিলদার পদে চাকুরি করতো। দেশের অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যেতে থাকায় শাহজাদপুর থানার সিও রেভিনিউ গোলাম কিবরিয়া সকল স্টাফ কে শাহজাদপুর থানার আশে পাশে থেকে অফিস করার আদেশ দেন। সে মোতাবেক মকবুল ও রহিমা আমার শশুর বাড়িতে থাকতো। তাদের সাথেও কুশল বিনিময় হলো।
পোতাজিয়াতে দিন কয়েক অপেক্ষা করার পর আমি বাড়ির পথে পা বাড়াবো ভাবতে থাকি কিন্তু অন্তসত্বা স্ত্রীকে ফেলে আমার কোথাও যাওয়া ঠিক হবেনা। এমনি ভাবে দিনাতিপাত করতে করতে ১৭ জুন ১৯৭১, আমার স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। পুত্রের নাম রাখা হলো শাকিল মাহমুদ বিপ্লব। আর কোন পিছু টান না থাকায় এবার সাহস করে বাড়ির পথে রওনা হলাম। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।