// সঞ্জু রায়ঃ উত্তরের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বগুড়ায় বড় বড় বাজার ও মার্কেটগুলোতে আজও নেই অগ্নি নির্বাপনের কোন ব্যবস্থা। সংকীর্ণ রাস্তা ও জরাজীর্ণ ভবনের সাথে অগ্নি ঝুঁকি বাড়াচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে থাকা বৈদ্যুতিক তারের জটলা। এমনকি এসব বাজারে নেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী ঢোকার রাস্তাও। আর যদিও বা গাড়ি ঢোকে তাহলে নেই পানির কোন উৎস। অগ্নিঝুঁকির আতঙ্কের মাঝেই নিজেদের জীবিকার তাগিদে ব্যবসায়ীরা পরিচালনা করছেন তাদের ব্যবসায়িক কর্মকান্ড। কবে দূর হবে এই আতঙ্ক জানা নেই কারো!
বগুড়ার বিভিন্ন মার্কেট ও বড় বড় বাজার ঘুরে দেখা যায়, শহরের প্রধান সড়ক কিংবা মার্কেটের সামনে থাকা বিদ্যুতের বিভিন্ন খুঁটিতে বৈদ্যুতিক তারের জটলা যেকোন সচেতন মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। অপরিকল্পিত আর ইচ্ছা স্বাধীনভাবে যে যেভাবে পেরেছে তারের কুন্ডলী পেঁচিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে বাঁধাও দেয়নি কেউ। আর ফোঁড়ের উপর বিষফোড় হয়েছে টেলিফোন, ইন্টারনেট, জেনারেটর, কেবল নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার তার। ফতেহ আলী বাজার, রাজা বাজার, নিউ মার্কেট, হকার্স মার্কেট, চুড়িপট্টিসহ প্রায় সকল হাট বাজার, বিপনী বিতান, বহুতল মার্কেট এলাকায় চোখে পড়ে তারের এমন জটলা। যেকোন সময় তারের এসব জটলা হতে পারে শটসার্কিটের কারন।
চুড়িপট্টির কসমেটিক্স ব্যবসায়ী অর্নব হাসান শুভ জানান, ঢাকায় বঙ্গমার্কেট ও নিউমার্কেটে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তা দেখার পরও তাদের মার্কেটের এই জরাজীর্ণ ও অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় তারাও অগ্নিঝুঁকির আতঙ্কে রয়েছে। তিনি বলেন কিছুদিন আগেও চুড়িপট্টির প্রবেশমুখে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটিতে হঠাৎ আগুন লেগেছিলো যদিও তা তেমন বড় আকার ধারণ করেনি তবু বড় হতে কতক্ষণ। তাইতো সময় থাকতেই সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
বগুড়ার আরেক ব্যবসায়ী শামসুজ্জামান সাগর বলেন, শহরের মার্কেটগুলোর যে অবস্থা তাতে যেকোন দিন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পানির স্থায়ী উৎস তো দূরের কথা কোন প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপনের নুন্যতম কোন ব্যবস্থায় রাখা হয়নি। ব্যবসায়ীদের অসচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের উদাসীনতা এর জন্যে অনেকটা দায়ী। তবে বিপদ হওয়ার পরে সচেতন হয়ে তো কোন লাভ নেই তাই সময় থাকতেই ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, শহরের প্রাচীন ও বড় বাজারদের একটি ফতেহ আলী বাজার যেখানে কোন ফাঁক নেই এক দোকান থেকে আরেক দোকানের মাঝে। মানুষ চলাচল করায় যেখানে চ্যালেঞ্জের বিষয় সেখানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির প্রবেশ যেন আসাধ্য বিষয়। আর কোন কারনে আগুন ধরলে তাৎক্ষনিক অগ্নি নির্বাপনের কোন ব্যবস্থাই নেই বাজারের একটি দোকানেও। একই অবস্থা চুড়িপট্টি, রাজাবাজার, নিউ মার্কেট, হকার্স মার্কেটেও। তাই কোটি কোটি টাকার মালামাল নিয়ে সব সময় ঝুঁকির মধ্যেই ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে রাজা বাজার আড়ৎদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ এই অবস্থার জন্যে সাধারণ ব্যবসায়ীদের উদাসীনতা ও দায়িত্বে অবহেলাকেই দায়ী করেছেন। তিনি প্রশাসনের তত্ত¡াবধানে দ্রুততম সময়ে বাজার ও মার্কেটগুলোর সকল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা নিশ্চিতের আহ্বান জানান যে কাজে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দদের পক্ষে তারাও সহযোগিতা করবেন।
এদিকে বগুড়া শহরের বাজার ও মার্কেটগুলোর অগ্নিঝুঁকির এমন আতঙ্কিত পরিস্থিতি উত্তরণে কি পদক্ষেপ নেয়া যায় এমন প্রশ্নে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, বগুড়ার সহকারী পরিচালক মঞ্জিল হক জানান, ২০১৮ সালেও পৌর এলাকায় ৯২টি জলাধার ছিলো। পরের দুই বছরে ভরাট হয়েছে ১৫টি। বাকিগুলোর কোনটি ভরাট প্রক্রিয়া চলমান আবার কোনটি জলশুন্য। তাদের সর্বশেষ জরিপে দেখা যায় বগুড়ায় ৭ থেকে ২১তলা পর্যন্ত বহুতল ভবন রয়েছে ৩১৩টি যেগুলোতে ইতিমধ্যে তারা তাদের তত্ত¡াবধানে অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা নিশ্চিতে কাজ শুরু করেছেন। এছাড়াও মার্কেটগুলোতে সচেতনমূলক বিভিন্ন প্রচারণা তারা চালাচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণে ইতিমধ্যে তারা কাজ শুরু করেছেন। তবে শহরে অগ্নিকান্ডের কোন ঘটনা ঘটলে তাদের তা মোকাবেলার সক্ষমতা আছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এদিকে সংকটের কথা হলো বগুড়ার শহরের বুকচিরে প্রবাহিত করতোয়া নদী পানির অন্যতম উৎস হলেও সেখানে যা আছে তা ব্যবহার অনুপযোগী। সর্বশেষ ২০১৮ সালে করা এক জরিপে বগুড়ায় ৬৭টি মার্কেট-শপিংমল ও ৪২ টি হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ ১০৯ টি বহুতল ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিলো ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। প্রায় ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাতেই রয়ে গেছে বাজার, মার্কেট এবং বহুতল ভবনগুলো। রাজধানী ঢাকায় একের পর এক অগ্নিকান্ডের ঘটনা এবার যেন সত্যি আতঙ্কিত করে তুলেছে বগুড়ার জনসাধারনকেও। তারপরেও কারও মাঝে এখনো দেখা যাচ্ছে না কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।
তবে এমন পরিস্থিতিতে বাজারগুলোতে অগ্নিনির্বাপক বাধ্যতামুলক করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দদের নিয়ে একটি সমন্বয় সভা করা হয়েছে যেখানে অগ্নিঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নে কাজও শুরু হয়েছে। তবে নিজেদের সুরক্ষার স্বার্থে ব্যবসায়ীদের সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেদের দায়িত্বশীল আচরণের প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি।