// এবাদত আলী //
১৯৭১ সালে মার্চ মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে রেহাই পাবার জন্য পাবনা শহর এবং শহরের বাইরে পাকা রাস্তার দুধারের বাসিন্দারা যে যার মত নিজেদের যতেœর ঘরবাড়ি ছেড়ে শহরতলীর আশে পাশে কিংবা দুরের কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে থাকে। অনেকে আবার ভারতের পথে পা বাড়ায়। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রাণ ভয়ে ভারতের পথে পাড়ি জমাতে থাকে। আমাদের বাড়িতেও মালিগাছা থেকে আমার বড় বোন, বোনের শাশুড়ি, জা, ননদ, প্রতিবেশি এবং আমার ফুফাতো বোন (মালিগাছা গ্রামের ইমান মাস্টারের স্ত্রী) সহ প্রায় ৬০জন লোক অসহায় অবস্থায় আশ্রয় নেয়।
তারা বেশ কিছুদন আমাদের বাড়িতে অবস্থান করে। আমাদের ঘরের মাচা বা মাচানে ডোল ভর্তি ধান ও চাউল এবং কয়েকটি ডোল ভর্তি গম ছিলো। নিজস্ব জমিতে উৎপন্ন ফসল সারা বছর খাবারের জন্য মজুদ ছিলো। আরো ছিলো কোলা বা মটকা ভর্তি আখের গুড়। আমার মা’ তাদের জন্য সকালে গমের রুটি এবং আখের গুড়, দুপুরে ডাল-ভাত এবং রাতের বেলা গমের ভাত রান্না করে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। এরই মাঝে আমার ফুফাতো বোনের এক ছেল সন্তানের জন্ম হয়। সে কি যে অবস্থা তা না দেখলে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। আমার মা এবং আমার স্ত্রী তার দেখাশোনা করতে থাকে।
এদিকে পিস কমিটির সদস্যদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জের হিন্দুদের বাড়ি ঘরে আক্রমণ শুরু করেছে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা বলতো ‘‘হাম মমুসলমান তোমভি মুসলমান, তোমহারা ছাথ দুস্তি ঠিক হায় লেকিন উহ হিন্দু উহ মালাউন হায়, উছকো ছাত কুউ দোস্তি কভি নেহি হোগা।’’ সে কথা বল্লে কি হবে নির্বিচারে হত্যা করার সময় মুসলমানদেরকেওতো তারা খাতির করেনি।
যাক এক দল পাকিস্তানি সৈন্য পাবনা শহর থেকে রওনা হয়ে মালিগাছা হয়ে তারা সোজা বাঙ্গাবাড়িয়া মাদ্রাসার পাশ দিয়ে সমসপুর হিন্দুপাড়া যায়। মিলিটারি আসবার খবর পেয়ে হিন্দু মুসলমান সকলেই গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী সমসপুর গ্রামে গিয়ে শরৎ চন্দ্র সরকার, বাঘা সরকার, অনিল চন্দ্র সরকার, পাঁচু দাস, বাউল চন্দ্র শিল, সুধিরসহ শতাধিক হিন্দু বাড়িতে লুট তরাজ করে। তারা কবি নজরুলের বাঁধানো ছবি ভেঙে ফেলে। অপর দিকে গোফ-দাড়ি থাকায় মুসলমান মনে করে তারা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির গায়ে হাত দেয়না। তারা যাবার সময় কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে দাপুনিয়া গ্রামের হিন্দু বাড়ি লুটতরাজসহ তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানিদের সাহায্য সহযোগিতা এবং তাদেরকে পথ-ঘাট দেখিয়ে দিবার জন্য জামায়াতে ইসলামির নেতা কর্মিরা শান্তি কমিটি নামক কমিটিতে যোগ দেয় যারা নাকি পরবর্তীতে রাজাকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিরা রাজাকার শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয় । যুদ্ধরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে রাজাকার দল গঠিত হয়। রাজাকার ফার্সি শব্দ। এর অর্থ স্বেচ্ছাসেবী। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগকালে তদানিন্তন হায়দ্রাবাদের শাসক নিজাম ভারতভুক্ত হতে অনিচ্ছুক থাকায় ভারতের সামরিক বাহিনীকে প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য রাজাকার নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানকল্পে মে মাসে খুলনায় খানজাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থী কর্মী নিয়ে হায়দ্রাবাদের রাজাকারের অনুকরণে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীকালে দেশের অন্যান্য অংশেও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিলো এলাকার শান্তি কমিটির নিয়ন্ত্রনাধীন।
১৯৭১ সালে ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পুর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তর করেন। তবে এর নেতৃত্ব ছিলো পাকিস্তানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত এক অধ্যাদেশ বলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়। রাজাকার বাহিনীর প্রাথমিক পর্যায়ের ট্রেনিংএর মেয়াদ ছিলো ১৫ দিন। ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় রাজাকার বাহিনীর প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষ হয়। পুর্বাঞ্চলীয় সামরিক অধিনায়ক জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর সাভারে রাজাকার বাহিনীর কোম্পানী কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে কচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী একটি সতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদায় উন্নিত হয়।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল তারিখে পুর্ব-পাকিস্তানের গভর্ণর টিক্কাখানের সঙ্গে সাক্ষাত করে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। আলাপ আলোচনা কালে ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে একটি সহযোগী বাহিনী গঠনের পরামর্শ দেন। জামাতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দি নির্মুল ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধ্বংসের জন্য পাকিস্তান সরকারকে পরামর্শ দিলে পাকিস্তান সরকার গোলাম আজমের পরামর্শ গ্রহণ করে রাজাকার বাহিনী নামে একটি বাহিনী গঠনের অধ্যাদেশ জারি করে। সেই মোতাবেক ১৯৭১ সালের মে মাসেই মওলানা এ কে এম ইউছুফের নেতৃত্বে ৯৬ জন জমায়াত কর্মী নিয়ে খুলনায় আনসার ক্যাম্পে সর্বপ্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান ইউছুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণ পরিচালিত হতে থাকে। মাত্র দেড় হতে দুই সপ্তাহ কাল ট্রেনিং দিয়েই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হতো ৩০৩ রাইফেল। মওলানা এ কে এম ইউছুেফর নেতৃত্বে গঠিত এই বাহিনীর নাম দেয়া হয় “রাজাকার” বাহিনী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যখন সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলে তখন জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতারা দেশে শান্তি কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে। শান্তি কমিটি গঠনের পর ১২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে প্রথম ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকায় একটি মিছিল বের করে। এতে নেতৃত্ব দেন জামাতে ইসলামীর আমীর মওলানা গোলাম আজম, খুলনার কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি পাবনা সাঁথিয়া থানার মওলানা মতিউর রহমান নিজামী প্রমুখ। (মওলানা মতিউর রহমান নিজামী মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাবার পর ২০১৬ সালের ১১ মে তারিখ রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিজামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।)
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।