ফেলে আসা দিন গুলো– ৩৪

// এবাদত আলী

পাবনা শহর থেকে দলছুট হয়ে পলায়নরত পাকিস্তানি সৈন্যরা পাবনা সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের অন্তর্গত জিয়িালগাড়া বিলে আশ্রয় নিয়ে পালিয়ে থাকারস্থায় জোতকলসা গ্রামের গহের আলী শেখকে গুলি করে হত্যা করার পর চারদিকি থেকে লোকজন ঘটনাস্থলে জড়ো হতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা পুণরায় পাবনা শহরের দিকে রওনা হয়।ততক্ষনে খবর পেয়ে পাবনা শহর থেকে জিপে করে ই পি আর, পুলিশ ও মুক্তিকামী সেচ্ছাসেবক দল মনোহরপুর বড় শাকোর কাছে এসে অবস্থান নেয়। উক্ত দলের সদস্যরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে মনোহরপুর উত্তর পাড়া আব্বাস ফারাজির আম বাগান এবং মালিগাছা গ্রামের মোল্লাপাড়াসহ অন্যান্য বাড়িতে অবস্থান নেয়। তারা গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মালিগাছা পাকা সড়কের উত্তরে কেফাত মোল্ল¬ার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বাংকার খনন করে গুলি ছুঁড়তে থাকে।
অপর দিকে জেলার আটঘরিয়া থানার এ এস আই (বাড়ি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানার বড়ভাগ গ্রামে।) থানা থেকে কয়েক জন পুলিশ ও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে পাকা রাস্তার দক্ষিন পার্শ্বে অবস্থান নেন। এ সময় আটঘরিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুর রহমান ফনি মিয়া ও মালিগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইদ্রিস আলী খান তাঁদের লাইসেন্সকৃত বন্দুক দিয়ে এক সঙ্গে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। ই পি আর পুলিশ ও সেচ্ছাসেবী মুক্তিকামীরা তিন দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। মালিগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ম জয়নুল আবেদীন, এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ( বর্তমানে সাংবাদিক ও কলামিস্ট ) বাদলপাড়া গ্রামের এবাদত আলী, একই গ্রামের আফ্ফান আলী, হিমায়েতপুর ইউনিয়নের চকচিরোট গ্রামের মোঃ হারেজ আলী, শামসুল আলম গান্ধী, মালিগাছা গ্রামের আব্দুল জব্বার (বর্তমানে সাংবাদিক ও লেখক), মনোহরপুর গ্রােেমর এইচ কেএম আবু বকর সিদ্দিক(বর্তমানে সাংবাদিক ও নাট্যকার), বারই পাড়া গ্রামের আবেদ আলী প্রামাণিক ওরফে বেগে, রাণীগ্রামের করিম ড্রাইভার, আবু সাঈদ, মনিদহ গ্রামের জালাল বিশ্বাস, রিয়াজ উদ্দিন, রামচন্দ্রপুর গ্রামের মতিয়ার রহমান, আটঘরিয়ার দেবোত্তর গ্রামের ডাঃ মিজানুর রহমান ওরফে প্রদীপ ডাক্তারসহ অগণিত মুক্তিকামি যোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
মালিগাছার সম্মুখ যুদ্ধে অতি সাহসি ভুমিকা নিয়ে এ এস আই আব্দুল জলিল এক সময় ২ জন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিষেধ উপেক্ষা করে দুর্বার সাহস নিয়ে শত্রু হননের জন্য মেতে উঠেন। তিনি পাকা সড়কের পাশে মাথা উঁচু করে কেফাত মোল্লার বাড়ির দিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান লক্ষ করে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। মুক্তিকামি সহযোদ্ধাগণ চিৎকার করে তাঁকে নিচে নেমে আসার অনুরোধ জানাতে থাকেন। কিন্তু তিনি কারো কথা কর্ণপাত না করে পাকিস্তানি হানাদারদের লক্ষ করে অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকেন। হঠাৎ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কয়েকটি বুলেট তাঁর মুখ, বুক ও মস্তক ঝাঁজরা করে দেয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
আব্দুল জলিল শহীদ হবার পর মুক্তিকামি যোদ্ধাদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। অপর দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একাধিক সৈন্য নিহত হওয়ায় বাকি সৈন্যরাও আপাতত গোলাগুলি বন্ধ রাখে। মালিগাছা রণাঙ্গনে নিহত পাকিস্তানি আর্মিদের নিকট থেকে অস্ত্র আনতে গিয়ে পাবনা শহরতলীর মক্তপাড়ার শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র আহসান শেখসহ অপর দুজন নিহত হন। পার্শ্ববর্তী ঘরনাগড়া গ্রামের আকমল হোসেন ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হন।
পরে আব্দুল জলিলের লাশ আটঘরিয়া থানায় নিয়ে যাবার পথে দেবোত্তর বাজারের পাশে জামে মসজিদ সংলগ্ন স্থানে কবর দেওয়া হয়। উক্ত স্থানে শহীদ আব্দুল জলিলের বাঁধানো কবর রয়েছে। (শহীদ আব্দুল জলিলের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার বড়ভাগ গ্রামে। তার তিন ছেলে। বড় ছেলের নাম আশরাফুল ইসলাম মুকুল আগেই মারা গেছেন। মেঝ ছেলে ইকবাল হোসেন বকুল ও ছোট ছেলে রফিকুল ইসলাম লিটন ফিনল্যন্ডের নাগরিক। ফিনল্যান্ডে তারা হোটেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর নাতিন জামাই লুৎফর রহমান (নতুন) ঈশ্বরদীতে বসবাস করেন। তারা গত ২০ শে আগষ্ট ২০১৪ পাবনার পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহমেদ এবং পাবনা সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে সাক্ষাৎ করেন। )
জিয়ালগাড়া বিলে নিহত গহের আলীকে সন্ধ্যার দিকে টেবুনিয়া গোরস্থানে দাফন করা হয়। অপর যুবকদের লাশ তাদের আত্মীয় স্বজনেরা নিয়ে যায়। মালিগাছার এই যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের মরদেহ এলাকার লোকজন পাশেই গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। কেফাত মোল্লার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে ক্ষুধা-তৃঞ্চায় কাতর বাদ বাকি সৈন্যরা সুযোগ বুঝে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর মালিগাছা রণাঙ্গনের সেই স্থানটি চিহ্নিত করে সেখানে একটি ‘স্মৃতি স্তম্ভ’ নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণসহ প্রতি বছর ২৯শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধের এই দিনটিকে স্মরণ করার লক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবাদত আলীকে সভাপতি ও সাংবাদিক ও নাট্যকার এইচকেএম আবু বকর সিদ্দিককে সহ সভাপতি, সাংবাদিক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারকে সাধারণ সম্পাদক করে “ মালিগাছা মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি” নামে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রতি বছর মালিগাছা রণাঙ্গনে স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়। । (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।