ফেলে আসা দিন গুলো-২২

// এবাদত আলী //
২৩ মার্চ ১৯৭১ পাবনাতে ব্যাপক মহড়া গণমিছিল ও বিশাল জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এদিন পাবনা টাউন হল মাঠে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পাবনা জেলা আহবায়ক সাহবিুদ্দিন চুপ্পু, ছাত্র লীগ নেতা আব্দুস সাত্তার লালু, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বকুল, ছাত্র নেতা, মোহাম্মদ ইকবাল, আ স ম আব্দুর রহিম পাকন, প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে পাবনার ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।
এর ফলে সারা শহরে পাকিস্তানি সেনারা টহল বাড়িয়ে দেয় এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্র লীগের নেতা-কর্মীদের পাকড়াও করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
পাবনা রূপকথা রোডের ( ইছামতি নদীর পুর্ব তীরের বাসিন্দা) ক্যাপ্টেন আজগর হোসেন জায়েদী তখন ছিলেন তৎকালীন খাদ্য ও কৃষি বিভাগের সংসদীয় সচিব। তারই নেতৃত্বে এ সময় তার সহযোগী পাঠান পাহারাদার উজির খান এবং আরো দু এক জন দালাল যেমন ডা.মোফাজ্জল হোসেন, মওলানা আব্দুস সোবহান, মওলানা ওসমান গণি খান, নুরু খন্দকার তারা পাকিস্তানি-বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় নেতৃবৃন্দের বাড়িতে অতর্কিতে হানা দিয়ে ২৬ মার্চ রাত ১১ টার দিকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পাবনা পৌরসভার চেয়ারম্যান ও পাবনা এডভোকেট বার সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোেেকট আমিনুদ্দিনকে তাঁর লাহিড়ীপাড়াস্থ বাসভবন ‘পুষ্পালয়’ থেকে বন্দি করে নিয়ে যায়। ভাসানী পন্থি ন্যাপ নেতা ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী (ট্রাফিক মোড়ের দাঁতের ডাক্তার ), পাবনার বিশিষ্ট মোটর গাড়ি ব্যবসায়ী ও তৎকালীন পাবনার বিলাস বহুল হোটেল ‘তৃপ্তি নিলয়’ এর মালিক আবু সাঈদ তালুকদার, এডরুক লিমিটেডের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আবদুল হামিদ, পাবনা পৌরসভার কর্মচারি আবদুল খালেক, পাবনা শহরের বাসিন্দা হাবিব, সিরাজ, বংশী বাদক শংকর চক্রবর্তী, স্কুল শিক্ষক জয়ন্ত রায় ও জনৈক রাজেন পাগলাকে ধরে নিয়ে যায়। এদেরকে কাশিপুর ইপসিক শিল্প নগরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্যাপক জিঞ্জাসাবাদের পর বাকিদেরকে ছেড়ে দেওয়া হলেও এডভোকেট আমিনুদ্দিন, আবু সাঈদ তালুকদার, ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী, ও রাজেন পাগলাকে অমানুষিক নির্যাতন করার পর নির্মম ও নিষ্ঠুর ভাবে হত্য করা হয়।
২৬ মার্চ কারফিউ চলাকালে চঞ্চলকে রাস্তার ওপর গুলি করে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মুজাহিদ ক্লাবের নিকট নিহত হয় আশরাফ আলী তপন। গুলিতে আরো নিহত হয় আবদুস শুকুর ও আবদুস সামাদ।
ঐ দিন কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা পাবনা শহরে মিছিল বের করে। এ দিকে পাক বাহিনী পাবনার পুলিশদেরকে আত্মসমর্পণ করানোর লক্ষে পাবনার এসপি চৌধুরী আবদুল গাফ্ফারকে এবং পুলিশ লাইনের আর আই খায়ের উদ্দিনকে বার বার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এ ঘটনার পর পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান পাবনার রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীসহ সকল স্তরের মানুষকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। কিন্তু সে আহ্বানে সাড়া দেবে কে? কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা পাবনা শহরে মিছিল করলেও মুল সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে দারুন বাধা ছিল তা হলো পাবনা টাউন হলে ২৩ মার্চ তারিখে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করার পর থেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে পাবনার প্রশাসন হুলিয়া জারি করেছিলেন। ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছিল।
অতঃপর জেলা প্রসশাসক নুরুল কাদের খান আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রব বগা মিয়ার মাধ্যমে তাঁদেরকে সাক্ষাৎ করার আহবান জানান। স্বাধীনতা সংগ্রামে পাবনা জেলার অন্যতম যোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল ( স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগ পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক, সাবেক এমপি এবং পরে বিএনপিতে যোগদান পুর্বক এমপি নির্বাচিত, যিনি ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা থেকে পাবনা ফেরার পথে বঙ্গবন্ধূ সেতুর পশ্চিম পাড়ে সিরাজগঞ্জের কোনাবাড়িয়া নামক স্থানে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত ), এবং আবদুস সাত্তার লালু ( স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের ১৩ জুলাই আততায়ীর হাতে নিহত ) তখন পলাতক। ডিসি নুরুল কাদের খান অনন্যপায় হয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পাশে পদ্মা চরের একটি বড়িতে আশ্রয় নিয়ে একটি গোপন মিটিং ডাকেন। উক্ত গোপন মিটিং এ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, ছাত্র নেতা সহ পাবনার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন। ডিসি জানালেন যে, পাকিস্তানি সেনারা তাকে বার বার খবর দিয়ে না পেয়ে তাঁর বাংলো ঘিরে ফেলার মুহূর্তে তিনি পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। ওরা বার বার পুলিশ বাহিনীকে তাগিদ দিয়ে চলেছে আত্মসমর্পণ করার জন্য। এ সময় পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গাফ্ফার ও ও দারুন উদ্বিগ্ন। ডিসি বল্লেন ‘আমি ওদেরকে বারণ করে দিয়েছি যেন ওরা তাদের হাতের রাইফেলের শেষ গুলিটি থাকা পর্যন্ত আত্মসমর্পণ না করে।
কিছুক্ষণ আগেও খবর পাওয়া গেছে যে, ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৬ টার দিকে এক বার পুলিশ লাইনের উপর হামলা করতে উদ্যত হয়েছিল।’ তিনি আরো জানালেন, পুলিশের আরআই খায়ের উদ্দিন খবর পাঠিয়েছেন অতি সত্তর সুষ্ঠু কোন সিদ্ধান্ত না নিলে পুলিশদেরকে আর ব্যারাকে রাখা যাবেনা। এ জন্যই আমি আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে বর্তমান পরিস্থিতির ওপর আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিতে চাই।’
উক্ত গোপন মিটিংএ ভবিষ্যৎ কর্মসূচির ভিত্তিতে উপস্থিত সকলে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে শপথ গ্রহণ করেন। ডিসি নুরুল কাদেও খান সকলকে শপথ বাক্য পাঠ করান। এমনি আলাপ আলোচনা করতে করতে রাত প্রায় ৮ টা বেজে যায়। এমন সময় হঠাৎ করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে শহরের দিকে হাজার হাজার গুলি বর্ষণ হতে লাগলো। গোপন মিটিং এ উপস্থিত সকলে তখন হতভম্ব হয়ে গেল। সর্বনাশ ওরা হয়তো গোপন মিটিং এর কথা জানতে পেরে চারদিক থেকে আক্রমনের বুহ্য রচনা করে এদিকেই আসছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দো তরফা গুলির শব্দ শুনে অনুমান করা গেল যে, পাবনা পুলিশ লাইনের পুলিশের ওপর আঘাত হানতে শুরু করেছে। ডিসি নুরুল কাদের খান ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে গোপন স্থানে রেখে রফিুকল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক ও বিভিন্ন স্থানে অপেক্ষমান রত ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের বজ্রকণ্ঠের ভাষণ ‘ তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’এই বাক্য সামনে রেখে আমরা সবাই এক জোট হয়ে শত্রু হননে মেতে উঠলাম। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।